স্থানীয়দের যোগসাজশে সক্রিয় ৪ রোহিঙ্গা গ্রুপ

  বিশেষ প্রতিনিধি    04-05-2023    85
স্থানীয়দের যোগসাজশে সক্রিয় ৪ রোহিঙ্গা গ্রুপ

অপহরণকারীদের আস্তানা কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের অংশ থেকে শুরু করে পূর্বে হ্নীলা ইউনিয়নের গহীন দুটি পাহাড়। এখানে খাবার-পানি, এমনকি বিদ্যুৎ সুবিধাও নেই।

কিন্তু গহীন পাহাড়ে দিনের পর দিন কীভাবে কাটাচ্ছে অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা- এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মাঠে নেমে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, পাহাড়ের অপহরণকারীদের সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে। সেখানে খাবার, পানি পৌঁছে দেওয়া, মোবাইল ফোন চার্জের জন্য পাওয়ারব্যাংক সরবরাহ করা, অপহরণের তথ্য দিয়ে সহায়তা করাসহ সব ধরনের খবরাখবর দিয়ে থাকে তারা। এ অপরাধচক্রের সঙ্গে স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধিও জড়িত বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কয়েক মাস আগে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল সকাল সাড়ে ৭টার আগে যেন কেউ পাহাড়ে না যায়। পাহাড়ে জীবিকার জন্য জমিতে বা পান বরোজে কাজ করতে গেলে যেন একসঙ্গে ১৫ থেকে ১৮ জন দলবেঁধে যায়। তাদের কাছে লাঠি ও বাঁশি রাখার পরামর্শও পুলিশের পক্ষে দেওয়া হয়। কিন্তু তা না মেনে অনেকেরই পাহাড়ে যাওয়ার তথ্য মিলছে।

সর্বশেষ গত সোমবার যে দুজনকে উদ্ধার করা হয়েছে, তারাও একা একা পাহাড়ে গিয়ে পান বরোজে কাজ করছিল। স্থানীয় কেউ-ই তাদের প্রবেশ করতে দেখে ওই তথ্য জানিয়ে দিয়েছিল অপহরণকারীদের। পরে টানা ৩৫ ঘণ্টার অভিযানে তাদের উদ্ধার করেছে পুলিশ।

গোয়েন্দা তথ্য অনুসারে অপহরণে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র চারটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এগুলো হলো সালমান গ্রুপ, সালে গ্রুপ, আবু আলা গ্রুপ ও নবী হোসেন গ্রুপ। পাহাড়ের আশপাশ এলাকার স্থানীয় লোকজন তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। এমনকি স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধিও অপহরণকারীদের সহযোগিতা করে আসছে বলে তথ্য মিলেছে। তারাই পুলিশের অভিযান তথ্য পাহাড়ে অবস্থান নেওয়া সন্ত্রাসীদের আগাম বলে দেয়। তথ্য যাচাই-বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে থানা ও জেলা পুলিশ যৌথভাবে কাজ করছে। যেকোনো সময় তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে পুলিশ।

টেকনাফ থানা পুলিশের তথ্যমতে, গত ছয় মাসে টেকনাফের পাহাড়কেন্দ্রিক অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবি ঘটনায় সাতটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৪৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। যার মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ১৩ জন।

তবে এলাকাবাসী বলছে, গত সাত মাসে টেকনাফের পাহাড়কেন্দ্রিক ৬০ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। টেকনাফ থানার ওসি মো. আবদুল হালিমও স্বীকার করেছেন, অপহরণের সংখ্যা তাদের নথিভুক্ত তথ্যের চেয়ে বেশি হতে পারে।

কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, অনেক অপহরণের ঘটনা আছে, যারা উদ্ধার পায় বা ফেরার পর পুলিশকে জানায় না বা মামলা করতে ভয় পায়। অপহৃত এমন দুজনের তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে, যারা ভয়ে থানা পুলিশকে কিছু জানায়নি।

পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, বাহারছড়া ইউনিয়নের পাহাড় থেকে গত ১৬ মার্চ নয়জনকে অপহরণ করা হয়। দুজনকে ছেড়ে দিয়ে সাতজনকে জিম্মি করে আদায় করা হয় মুক্তিপণ। গত ১৮ মার্চ এই সাতজন ফেরার পর জানা যায়, ‘অপহৃত’ তিনজন অপহরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তাদের উদ্ধারের পর গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া ওই চক্রের ছয় সদস্যকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। এর মধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। অপহরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা হলো গিয়াস উদ্দিন, জায়নুল ইসলাম ও আরিফ উল্লাহ। অপহরণচক্রের চিহ্নিত সদস্যরা হলো স্থানীয় চৌকিদার মোহাম্মদ ইছাক, মো. সেলিম, আইয়ুব, মুসা, কালু ও নুরুল। চৌকিদার মোহাম্মদ ইছাক ও মো. সেলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এ প্রসঙ্গে জেলা পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানান, ওই ঘটনায় সবাই মিলে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ পরিশোধের পর ছেড়ে দিলে তারা সবাই রহস্যজনক কারণে আরও আট ঘণ্টা পাহাড়ে ছিল। এই সাতজনের মধ্যে গিয়াস উদ্দিন, জায়নুল ইসলাম ও আরিফ উল্লাহ অপহরণচক্রের সঙ্গে জড়িত। তাদের কাছে মোবাইল ছিল। মুক্তিপণের জন্য তারা নিজের পরিবারসহ বাকি চারজনের পরিবারে দফায় দফায় ফোন করে। জিম্মি থাকা অবস্থায় এই তিনজন ছাড়া বাকি চারজন মারধরের শিকার হয়। এর মধ্যে গিয়াস চক্রের চিহ্নিত সদস্য চৌকিদার ইছাকের ছেলে।

এসপি মাহফুজুল ইসলাম বলেন, এই জিম্মিদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করে সেলিম। সেই টাকা নিজ বাড়িতে রাখে। টাকা পাওয়ার এক ঘণ্টা আগেই জিম্মিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই মামলাটি এখনও তদন্ত চলছে।

এসপি জানান, টেকনাফের পাহাড়কেন্দ্রিক অপহরণের নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করা গেছে। একইসঙ্গে জড়িত কারা, সহযোগী কারা, কোন কোন পাহাড়ের অংশে এসব অপহরণ তা শনাক্ত হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে অপহরণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেবে পুলিশ। এর জন্য সাধারণ মানুষের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

অপহরণ রোধে সিসি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ টেকনাফ সড়কের মাত্র আধাকিলোমিটার এলাকা। যার দক্ষিণে সদর ইউনিয়নের কেরুনতলী এলাকায় অবস্থিত টেকনাফ স্থলবন্দর। উত্তরে হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া এলাকার সেন্টমার্টিনগামী জাহাজঘাট। এর মধ্যবর্তী আধাকিলোমিটার এলাকার সড়কটি অনেকটা জরাজীর্ণ। সড়কের পূর্ব নাফ নদের পাড় ও পশ্চিমে পাহাড়ের পাদদেশ জুড়ে কেবল ঝোপ-জঙ্গল। যে জঙ্গলের পুরো অংশেই বেতগাছ। টেকনাফ থানার ওসি আবদুল হালিম বলেন, এই স্থানটি এখন অপহরণকারীদের অভয়ারণ্য।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে ঘটনাস্থল ঘুরে কিছু যানচলাচল চোখে পড়ে। এখান দিয়ে চলাচলের সময় ভয়ে থাকেন যানবাহনের চালকরাও। এই দুই প্রতিবেদকসহ কয়েকজনকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক চালক গাড়ি থামিয়ে দেন, তার চোখেমুখে তখন আতঙ্কের ছাপ।

বিষয়টি টেকনাফ থানার ওসি আবদুল হালিমকে জানালে তিনি বলেন, টেকনাফ স্থলবন্দরটির অভ্যন্তরে সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে; রয়েছে সন্ধ্যার পর থেকে আলোকবাতির ব্যবস্থা। ইতোমধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষকে পুলিশের পক্ষে অনুরোধ জানানো হয়েছে সড়কের দিকে সিসিটিভি ক্যামেরা এবং বাতি স্থাপনের।

বন্দর কর্তৃপক্ষ তা করবে বলে আশ্বস্ত করেছে। একইসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান, বন বিভাগকে অনুরোধ জানানো হয়েছে এই আধাকিলোমিটার এলাকায় ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করে মধ্যবর্তীস্থানে পুলিশের ২৪ ঘণ্টা অবস্থানের জন্য একটি পর্যবেক্ষণ চৌকি স্থাপনের জন্য। এসব উদ্যোগ কার্যকর করা সম্ভব হলে আধাকিলোামিটার এলাকার অপরাধ দমনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

হ্নীলা, বাহারছড়া ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের এলাকায় সিসিটিভি বসানোর কার্যক্রম চলছে বলেও জানান ওসি। সুত্র:প্রতিদিনের বাংলাদেশ

সারাদেশ-এর আরও খবর