কক্সবাজারে লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মেঘা প্রকল্পগুলো বোঝা হওয়ার আশঙ্কা

  বিশেষ প্রতিনিধি    04-02-2023    337
কক্সবাজারে লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মেঘা প্রকল্পগুলো বোঝা হওয়ার আশঙ্কা

বাংলাদেশর দক্ষিণ অঞ্চল কক্সবাজার জেলাকে বিদ্যুৎ-জ্বালানি এবং লজিস্টিক হাবের পাশাপাশি সমুদ্র তীরবর্তী শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছে সরকার। হাতে নেয়া হয়েছে একাধিক মেগা প্রকল্প। পরিকল্পনায় রয়েছে আরো কয়েকটি। নির্মাণ হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনালসহ একাধিক অর্থনৈতিক অঞ্চল। যদিও এসব এলাকায় সহায়ক অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত মাত্রায় নিশ্চিত করা যায়নি।

প্রস্তুতিমূলক এক সমীক্ষার ভিত্তিতে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, যথাযথ মাত্রায় নগর উন্নয়ন ও অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানো না গেলে প্রকল্পগুলো থেকে কাক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না। উল্টো কয়েক লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পগুলো নিয়ে নতুন করে সংকট দেখা দিতে পারে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোর বিভিন্ন উপজেলা, পৌরসভার বর্তমান সক্ষমতা, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধার পর্যাপ্ততা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সমীক্ষাটি চালানো হয়।

এসব মেগা প্রকল্পের মধ্যে কক্সবাজার জেলার টেকনাফের সাবরাং ও নাফ ট্যুরিজম পার্ক, মহেশখালীতে স্পেশাল ইকোনমিক জোন, মহেশখালী ইকোনমিক জোন-৩ (ধলঘাটা) ও মহেশখালী স্পেশাল ইকোনমিক জোনের (ঘাঁটিভাঙা) নির্মাণকাজও চলমান। এছাড়া মহেশখালী স্পেশাল ইকোনমিক জোন (ঘাঁটিভাঙা-সোনাদিয়া), মহেশখালী ইকোনমিক জোন (কালারমারছড়া), মহেশখালী ইকোনমিক জোন-১, মহেশখালী ইকোনমিক জোন-২-এর (কালারমারছড়া) নির্মাণ পরিকল্পনাধীন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষিণ অঞ্চল কক্সবাজারের অর্থনৈতিক অঞ্চল, গভীর সমুদ্রবন্দর, একাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে সেখানে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক-কর্মচারীর প্রয়োজন পড়বে। এছাড়া প্রয়োজন পড়বে উন্নত সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কেরও। কিন্তু এখনো বিষয়গুলো নিয়ে সেভাবে প্রস্তুত নয় স্থানীয় প্রশাসন। ফলে মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন শেষে কার্যক্রম শুরু হলে বড় ধরনের সংকটে পড়তে হবে প্রকল্প পরিচালনাকারী সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে। সামাজিক ও নাগরিক সেবা উন্নয়ন না হলে বড় বিনিয়োগগুলো সুফলদায়ী প্রকল্পের পরিবর্তে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করছেন জাইকাসহ দেশী-বিদেশী উন্নয়ন পর্যবেক্ষকরা।

লজিস্টিক হাব হিসেবে দক্ষিণ চট্টগ্রামকে রূপান্তর পরিকল্পনার মূল অনুষঙ্গ হলো মাতারবাড়ীতে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর। চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়ন ছাড়াও বে-টার্মিনাল নির্মাণকাজও শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ ও ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ের মাধ্যমে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চল যুক্ত হবে সড়ক ও রেলপথভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে।

বিদ্যমান দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথকে কক্সবাজারের সঙ্গে যুক্ত করার কাজ এরই মধ্যে শেষ পর্যায়ে। যদিও মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক বৈরিতায় অনিশ্চয়তার মুখে ঘুনদুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ। ২০২৫ সালের দিকে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজ শুরুর বিষয়ে জাইকার সঙ্গে এরই মধ্যে চুক্তি হয়েছে। তবে বে-টার্মিনাল নির্মাণসহ চট্টগ্রাম বন্দরের ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজ এগোচ্ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। এতে এ পরিকল্পনার সুফল কতটুকু সুদূরপ্রসারী হবে সেটি নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

পাওয়ার অ্যান্ড লজিস্টিক হাব হিসেবে দক্ষিণ অঞ্চলের কক্সবাজারকে গড়ে তোলার পরিকল্পনা এখন অনেকটাই বাস্তব রূপ নিয়েছে। মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকাজও চলমান। এ অঞ্চল থেকে জাতীয় গ্রিডে কয়েক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেবল সঞ্চালনে একটি ছাড়া আর কোনো প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন-পুরনো সঞ্চালন লাইন নির্মাণ-সংস্কার এবং সাব স্টেশন স্থাপনে আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালে। প্রকল্পটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করা যাবে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় খোদ বিপিডিবি কর্তৃপক্ষও।

জানতে চাইলে বিপিডিবি চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিপিডিবি বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রামসহ কক্সবাজার পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিতরণে সঞ্চালন লাইনের উন্নয়নে আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ শুরুর দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। বিদ্যমান লাইন দিয়ে শিল্প-কারখানার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়া সম্ভব হলেও দীর্ঘমেয়াদে ভারী শিল্প-কারখানার প্রয়োজনে নতুন এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’

মহেশখালীতে ২০১৮ সালে নির্মিত ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল দিয়ে বর্তমানে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামে নির্মীয়মাণ বেশ কয়েকটি গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যও এ টার্মিনাল দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করা হবে। তবে টার্মিনাল স্থাপনের পরও যদি পাইপলাইন নির্মাণের মাধ্যমে সরবরাহ ব্যবস্থা স্থাপন করতে বেশি সময় লেগে যায়, তবে তা এ পরিকল্পনা সফল বাস্তবায়নের পথে বাধা হবে দাঁড়ানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তবে কক্সবাজার জেলায় শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে এখন বিনিয়োগকে চিহ্নিত করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, এখানে এখন প্রায় সব বিনিয়োগই হচ্ছে বিদেশী ঋণ সহায়তায়। বড় বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের পর প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুবিধা দেয়া না গেলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগও মুখ থুবড়ে পড়বে।

এক দশকেরও বেশি সময় আগে পরিকল্পনা করা হলেও চট্টগ্রাম বে-টার্মিনাল নির্মাণকাজ শুরুই করতে পারেনি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কক্সবাজারের নাফ নদীর নাব্যতা সংকট ও মিয়ানমারের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক এ অঞ্চলের শিল্পায়নের পথে অস্বস্তি তৈরি করেছে। অপরদিকে কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীবন্দর নির্মাণের প্রজ্ঞাপন জারি হলেও সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ। ফলে টেকনাফ, মহেশখালী, মাতারবাড়ী, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় নির্মিতব্য শিল্প জোনের কারখানাগুলোর পণ্য পরিবহনে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।

প্রক্ষেপণ রয়েছে, শুধু কক্সবাজারে ২০২৬ সাল নাগাদ জনসংখ্যা বাড়বে ৪০ হাজার। ২০৪১ সালে তা দাঁড়াবে ১ লাখ ১০ হাজারে। এছাড়া বাড়তি সংকটের কারণ হয়ে উঠেছে মিয়ানমার থেকে আসা ৯ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে কক্সবাজারের বর্ধিত জনসংখ্যার সঙ্গে আরো কয়েক লাখ শ্রমিক-কর্মচারী যুক্ত হবে, যা বর্তমান অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। এজন্য সড়ক ও সেতু নির্মাণ, ড্রেনেজ অবকাঠামো সংস্কার ও নির্মাণ, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা স্থাপন, আধুনিক বর্জ্য ও পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছাড়াও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা বাড়াতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় পরিকল্পিতভাবে শিল্পায়নের জন্য অবকাঠামো নির্মাণকাজ করা হচ্ছে। সড়ক যোগাযোগ ছাড়াও নানামুখী অবকাঠামো নির্মাণে এরই মধ্যে বেশকিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ধীরে হলেও প্রতিটি অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ, আবাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা ছাড়াও সামাজিক উন্নয়নের প্রকল্প বাস্তবায়নে বেজা কাজ করছে।’

সারাদেশ-এর আরও খবর