মূল-শায়খুত তাফসীর আল্লামা আহমদ আলী লাহোরী রহ.
ভাষান্তর: মাওলানা কাযী মোহাম্মদ এরশাদুল্লাহ
ইসলামের পাঁচ আরকানের অন্যতম হচ্ছে রমাযান মাসের রোযা। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, “রমাযান মাসই হলো সে মাস যাতে নাজিল করা হয়েছে কুরআন। যা মানুষের জন্য হেদায়ত এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসূস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্যদিন গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না। যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়ত
দান করার দারুণ আল্লাহ তা’আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।” – (সূরা আল বাকারা, আয়াত-১৮৬।)
কুরআনে হাকীমের বার্ষিকী:
লাওহে মাহফুয থেকে কুরআনে হাকীমের অবতরণ রমাযান মাসেই হয়েছে। সমগ্র কুরআনে হাকীম একত্রে পৃথিবীর আকাশ বা নিম্নতম আসমানে অবতীর্ণ হয়। অতঃপর সময়ে সময়ে অল্প অল্প অবতীর্ণ থাকে। প্রত্যেক জাতির একটা রীতি এই যে, যেদিন তাদের ওপর কোন নিয়ামত নাজিল হয় ওই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তারা বার্ষিকী পালন করে। উদাহরণ
স্বরূপ ইহুদীদের মধ্যে আশুরার রোযা। ঈসায়ীদের মধ্যে আসমান থেকে বিশেষ খাবার অবতীর্ণ হওয়ার দিন। মুসলমানদের জন্য কুরআনে হাকীম হচ্ছে এক আযীমুশশান নিয়ামত। এজন্য তার বার্ষিকী রমাযানুল মোবারকে উদ্যাপন করা হয়। সারা রমাযান মুসলমানগণ রাত্রে (তারাবীহর নামাযে) কুরআনুল কারীমের তিলাওয়াত শুনেন। তথাপি এ মহান নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ দিনে সিয়াম পালন করেন। নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ রোযা রাখার প্রচলন পূর্ববর্তী উম্মতদের মধ্যেও ছিল। যেমন ইহুদীদের মধ্যে আশুরার রোযার প্রচলন এজন্য ছিল যে, সেদিন ফিরআউন নীল নদে ডুবেছিল। আর বনী ইসরাঈল
( হজরত মুসা আ. ও তাঁর অনুসারীবৃন্দ) মুক্তি পেয়েছিলেন।
সমস্ত উম্মতের মধ্যে রোযা:
কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে ‘‘তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর। যেন তোমরা পরহেজগারি অর্জন করতে পার।’’ – (সূরা- আল-বাকারা, আয়াত-১৮৪।) এতে বোঝা যায় পূর্ববর্তী নবীগণের আ. শরীয়তেও এভাবে রোযা রাখা হত যে, রোযার দিনে খাওয়া-দাওয়া ও স্ত্রী সহবাস হারাম
ছিল। রোযার এই পদ্ধতি হজরত আদম আ. থেকে হজরত ঈসা আ. পর্যন্তবিদ্যমান ছিল। প্রথম প্রথম যখন মুসলমানদের ওপর রোযা ফরজ করা হল, এর শর্তাবলী সম্পর্কে তারা অবগত ছিল না। তখন তারা আহলে কিতাবদের মত রোযা রাখতে শুরু করলেন। ইফতারের পরে নিদ্রা যাওয়ার আগেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতেন। ঘুমানোর পর পুনরায় অপর রোযা শুরু হয়ে যেত। কিছুদিন পর ‘‘রোযার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করা তোমাদের জন্য হালাল করা
হয়েছে।’’ – ( সূরা-আল বাকারা, আয়াত-১৮৭)।আয়াতটি নাযিল হলে ওই পন্থা রহিত হয়ে যায়।
রোযার সময়ের ভিন্নতা:
ইতিহাসের পাতা উল্টালে একথা প্রতীয়মান হয় যে, রোযার সময় প্রত্যেক উম্মতের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ছিল। যেমন হজরত আদম আ. এর ওপর প্রতি মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের রোযা ফরজ ছিল। হজরত নূহ আ. সর্বদা রোযা পালন করতেন। হজরত দাউদ আ. একদিন রোযা রাখতেন আরেকদিন ইফতার করতেন ( তথা রোযা ছেড়ে দিতেন)। ইহুদীদের ওপর আশুরার দিন ও শনিবারের রোযা ছাড়াও আরও কিছুদিন সমূহের রোযা ফরজ ছিল। হজরত ঈসা আ. একদিন রোযা রাখতেন আর দুইদিন ইফতার করতেন।
নাসারাদের ওপর মূলতঃ রমজানের রোযাই ফরয ছিল। কিন্তু তাদের নিকট যখন অতি গরম ও অতি শীতের মৌসুম রোযা কষ্টকর মনে হল, তারা এই সিদ্ধান্ত নিল যে বসন্তকালে ত্রিশটির স্থলে পঞ্চাশটি রোযা রাখবে।
আকৃতিসর্বস্ব প্রাণহীন রোযা নিষ্ফল :
প্রত্যেক বিবেকবানের রীতি এই যে, সে যখন কোন কাজ করে প্রথমেই তার উপকারিতা বিবেচনা করে। ওই উপকারিতা হচ্ছে কর্মের রুহ বা প্রাণ। রোযার ও একটি আকৃতি রয়েছে এবং আরো আছে তার রুহ । আকৃতি হলো সুবেহ সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা। স্বামী-স্ত্রী পরস্পর সহবাস না করা। কিন্তু রোযার মৌলিক উদ্দেশ্য যদি এই আকৃতির মধ্যে পাওয়া না যায় তাহলে তা বেকার ও নিষ্ফল। এ প্রসঙ্গে দরবারে নবুওয়াত হতে ইরশাদ হচ্ছে: “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও তদানুযায়ী কাজ করা ছেড়ে দেয়নি তার পানাহার পরিত্যাগ করার প্রতি আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।”
(অর্থাৎ রোযার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভ করা প্রয়োজন ছিল, এটা হবেনা)। অপর বর্ণনায় এসেছে “পরনিন্দা দ্বারা রোযা ভেঙে যায়।” এতে জানা গেল যে, রোযা অবস্থায় উপরোক্ত কাজসমূহ অবৈধ।
এভাবে অপরের নিন্দা করা, যা হচ্ছে জিহ্বার অপরাধ তাও নিষিদ্ধ। এতে প্রমাণিত হয় যে, রোযার উদ্দেশ্য শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকা নয়, বরং তার উদ্দেশ্য আরো মহৎ ও ব্যাপক।
রোযার প্রাণ:
ইসলামী শিক্ষার বৈশিষ্ট্য এই যে, এর দ্বারা মানুষের মধ্যে উত্তম চরিত্রের বিকাশ ঘটে। প্রশংসনীয় গুণাবলী দ্বারা সে সুশোভিত হয়। মন্দ আচার-আচরণের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। খাহেশাতে নফসানীকে (রিপূর অনৈতিক তাড়না) সে অবদমিত করে । নফসকে নিয়ন্ত্রণ ও সহনশীলতায় অভ্যস্ত হয়। ফিতনা সৃষ্টি হতে সে দূরে থাকে, মন্দ কাজ হতে বিরত থাকে। এই সব সদগুণাবলি তৈরির জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা হল মানব স্বভাবকে হিংস্র চরিত্রের ছোবল হতে মুক্ত করা। এই
বিষকে দূরীভূত করার উত্তম মহৌষধই হচ্ছে এই রোযা।
পাশবিকতার তীব্রতার কারণেই মানুষের মধ্যে যাবতীয় মন্দ স্বভাবের উৎপত্তি হয়। যদি (মানুষের মধ্যে বিদ্যমান) পাশবিকতাকে দুর্বল করে দেয়া যায় তাহলে অনেক পাপাচার থেকে নিশ্চয় মানুষ মুক্ত থাকবে। এমনিভাবেই এই নীতির আলোকে ইসলামী শরীয়তে রোযাকে যাচাই করা হোক; তাহলে প্রমাণিত হয় যে, নবী কারীম সা. রোযার মাধ্যমেই স্বীয় উম্মাতকে আখলাকের সর্বোচ্চ মানে উন্নীত করার প্রয়াস পেয়েছেন।
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, “রোযাদার ব্যক্তি মহিলাদের সাথে যৗন সংশ্রবের কোন কথা বলবেনা এবং অহেতুক শোরগোল করবেনা। যদি কেউ তাকে কটূক্তি করে বা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, (সে নিজে তার মোকাবিলায় কিছু করবেনা) তাকে এতটুকুই বলে দেবে যে, আমি রোযাদার ।
হাদিসের ব্যাখ্যা:
হাদীসে কতিপয় বিষয় পরিত্যাগ করতে বলা হয়েছে, যথা- রাফাছ, ছাখাব, সাব্ব, কাতল । ‘‘রাফাছ’’ পরিত্যাগ এর মর্মার্থ হচ্ছে যৌন বিষয়ক কথাবার্তা ও কার্যাবলী থেকে বিরত থাকা । “ছাখাব” পরিত্যাগ এর মর্মার্থ হচ্ছে পশুদের মত শোরগোল থেকে বিরত থাকা। ‘‘সাব্ব’’ পরিত্যাগ থেকে যে কোন অশিষ্ট কথা-বার্তা থেকে বিরত থাকা উদ্দেশ্য। ‘‘কাতল’’ পরিত্যাগ থেকে উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে কোন নিন্দনীয় কাজ কর্ম থেকে দূরে
থাকা। ‘‘আমি রোযাদার’’ এর মর্মার্থ হচ্ছে রোযাদারের ওপর যখন কোন কটূক্তিকারী অত্যাচারী ও মূর্খের পক্ষ থেকে হামলা আসে তখন এটাই বলে দেবে যে, (কিন্তু এই বলার দ্বারা তার মধ্যে যেন রিয়া না আসে) ‘‘আমি রোযা রেখেছি তাই তোমার মোকাবিলা করতে অক্ষম।’’ হাদীসের কোন ব্যাখ্যাকারের মত হচ্ছে, মুখে বলারও প্রয়োজন নেই । অন্তরে রোযার কথা স্মরণ করে মোকাবিলা থেকে বিরত থাকবে।
দ্বিতীয় হাদীস- রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, “রোযা হচ্ছে ঢাল স্বরূপ’’ ঢাল দ্বারা মানুষ শত্রুর আঘাত থেকে আত্মরক্ষা করে প্রথম হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, রোযাদার ব্যক্তি যৌন বিষয়ক কাজ ও কথা বার্তা এবং পশুবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। ফিতনা-ফাসাদের আগুনকে নিভিয়ে ফেলবে। কেননা নিন্দা অথবা লড়াইয়ের জবাব যদি সেভাবেই দেয়া হতো তাহলে ফিতনা শুরু হয়ে যেতো। এখন রোযার কারণে ওই অগ্নি নির্বাপিত হয়েছে। সার কথা হলো, সে রোযার ঢালের সাহায্যে শয়তান ও প্রবৃত্তির লালসাকে প্রতিহত করেছে।
রোযার দ্বারা চারিত্রিক ও সামাজিক সংশোধন :
পূর্ববর্তী হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, রোযাদারের আখলাকের মান উন্নত হয়ে যাবে। প্রবৃত্তির অবদমন ও সহনশীলতার শক্তি আসবে। সে মন্দকাজ ও ফিতনা থেকে নিজকে বাঁচিয়ে রাখবে। তাকে দেখা যাবে পৃথিবীর প্রথম সারির শান্তিকামী ও ভদ্রশিষ্ট-সম্ভ্রান্ত। সাথে সাথে তার সামাজিক সংশোধনও হয়ে যাবে। যখন প্রত্যেক মুসলমান এই সব প্রশংসনীয় গুণাবলীতে সুশোভিত হয়ে যাবে তখন সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবেনা। কেননা, প্রতি বছর রোযা রাখার বিধানের উদ্দেশ্যই হচ্ছে পূর্ণ
এক বছর পরে পূনরায় এই কোর্সের পুনরাবৃত্তি ।
রাজনৈতিক উপকারিতা :
পৃথিবীতে ওই জাতিই মর্যাদার সাথে টিকে থাকতে পারে যাদের কাছে জাতীয় জীবনের উন্নত সংবিধান থাকে । আর তারা এর বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করে। যে কোন বিপদের সামনে বুক টান করে দাঁড়িয়ে যায় । রোযার মধ্যে এ বিষয়েরই অনুশীলন করানো হয় যে, বার বা চৌদ্দ বরং কোন সময় চব্বিশ বা চৌদ্দ ঘণ্টাই অনাহারে থাকবে। তীব্র গ্রীষ্মের মৌসুমই হোক না কেন। সাহরির সময় আহার করতে পারেনি, তবুও রোযা ছেড়ে দিতে পারবেনা। দিনের কাজ কর্মের কোন ব্যাঘাতও ঘটাতে পারবেনা, বরং চাষী, চাকুরীজীবি, শ্রমিক মোট কথা প্রত্যেক কর্ম ও পেশাজীবী সাহরী না খাওয়া সত্তে¡ ও নিজ নিজ কাজে ব্যস্তহবে । শুধু এই নয়, দিনের বেলা এই সব কষ্ট স্বীকার ও রাত্রে জাগরণ করে আর দীর্ঘ সময় দাড়িয়ে তারাবীহ’র নামায আদায় করবে। সারকথা এই যে, প্রত্যেক মুসলমান হচ্ছে একজন যুদ্ধের সৈনিক। বিস্কুট-কেক, শরবত-পানীয়তো দূরের কথা; বরং
পানি পান আর খাবার গ্রহণ ছাড়াও যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা বিরামহীন কাজ করতে পারে এবং এই বিষয়েও দৃঢ় প্রত্যয়ী যে, এই সব কষ্ট-ক্লেশ ও আত্মত্যাগ কারো ওপর দয়া স্বরূপ নয় ; বরং তার কাছে শুধুমাত্র আল্লাহ তা’আলার রেযামন্দীই হচ্ছে মুখ্য। ইসলামের বিজয়াভিযান সমূহে এ ধরণের অসংখ্য ঘটনা পাওয়া যায় । দিন-রাত অনবরত চব্বিশ ঘন্টা লড়াই চলছে; ইসলামের শত্রুদের সৈন্য দল একের পর এক আসতে থাকে; কিন্তু মুসলমান ওই পর্যন্ত
পিছু হটেনি যতক্ষণ বিজয় মুকুট ছিনিয়ে নেয়নি।
ইসলামের বিজয় বার্তা :
ভূপৃষ্ঠের উপর যে জাতির ৪০ কোটি (বর্তমানে-প্রায় ২০০কোটি) সদস্য বিদ্যমান থাকে এবং তারা যদি ওই সব নীতিমালার অনুগত হয়ে যায় যেগুলো ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলী হিসাবে তাদের শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, “বিজয় অর্জন করতেই হবে নয়তো ধ্বংস অনিবার্য।” তাহলে ওই জাতি কোন দিন ধ্বংস হতে পারে না। বরং তারা দুনিয়ার অপরাপর জাতির সর্দার হয়েই থাকবে । কেননা স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের পৃষ্টপোষকতা
করবেন । দৃশ্য-অদৃশ্য, আকাশ-পৃথিবীর সমস্ত খোদায়ী শক্তি ও ব্যবস্থাপনা তাদের নিমিত্ত ওয়াক্ফ হয়ে যাবে।
আল-াহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন, “যদি তারা তাওরাত, ইঞ্জিল এবং যা প্রতিপালকের পক্ষ হতে তাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে (কুরআনে কারীম) পুরোপুরি পালন করত, তবে তারা উপর থেকে এবং পায়ের নীচ থেকে আহার্য লাভ করত।”-(সূরা: আল-মায়িদাহ্, আয়াত : ৬৬)।
রোযার পরজাগতিক উপকারিতা :
রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি এই অবস্থায় রোযা রেখেছে যে, তার অন্তরে ঈমান বিদ্যমান রয়েছে এবং আল্লাহর কাছে প্রতিদান প্রাপ্তির উদ্দেশ্যেই রেখেছে তার পূর্ববর্তী সমস্তগোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। এবং যে ব্যক্তি রামাযানের রাত্রে ঈমানের সাথে ইবাদত করে এবং সওয়াব অর্জনের ইচ্ছা রাখে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে আল্লাহর কাছে ছাওয়াব প্রাপ্তির আশা নিয়ে রাত জেগে ইবাদত করে তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।”
মাগফিরাতের রহস্য:
রোযার কারণে পূর্বের সমস্তগুনাহ্ মাফ হওয়ার রহস্য এটাই মনে হচ্ছে যে, রোযাদার তার অবস্থার ভাষায় (সার্বিক কার্যাবলীর মাধ্যমে) যেন বলে যাচ্ছে যে, হে আল্লাহ আমি খাওয়া-দাওয়া আর প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণে তোমার মর্জির খেলাফ যে সব কাজ করেছিলাম তা থেকে প্রত্যাবর্তন করছি। আর তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই সবকিছু পরিত্যাগ করছি। এবং অবিরাম রোযা পালন করে একথা প্রমাণ করছি যে, তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো, তোমার সন্তুষ্টির খেলাফ প্রবৃত্তির চাহিদাকে সর্বদা পরিহার করে চলবো ।
রামাযান শরীফ ছাড়াও শাওয়ালের ছয় রোযা রেখে সে যেন একথার প্রমাণ দিচ্ছে যে, হে আল্লাহ, তুমি নিজ মেহেরবাণী ও দয়ায় একথার ঘোষণা দিয়েছো যে, আমি প্রত্যেক ভাল কাজের প্রতিদান কমপক্ষে দশগুণ দেব। এই হিসেবে রমাযানুল মোবারক ছাড়াও শাওয়ালের ছয় রোযার বিনিয়ে কমপক্ষে ৩৬০ রোযার প্রতিদান পাওয়া যাবে । বছর ৩৬০ দিনে হয়।
সুতরাং আমি যেন তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সারা বছরই রোযা রেখেছি। এই ভাবে রমাযানুল মোবারকে রাত্রি জাগরণের উদ্দেশ্যও এই যে, ‘‘হে আল্লাহ আমি যে তোমার কুরআনে হাকীম থেকে বিমুখ হয়ে পড়েছি তা থেকে অনুতপ্ত হয়ে কুরআনকে মজবুত করে আঁকড়ে ধরার বাস্তব (আমলী) প্রমাণ দিচ্ছি।’’ মুসল্লী বিরামহীন রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে কার্যত এটাই ব্যক্ত করছে যে, ‘‘আমার পক্ষ হতে কুরআনকে মজবুত করে আঁকড়ে ধরার প্রত্যয় ভবিষ্যতে সর্বদা বজায় থাকবে।’’ হজরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সা. ফরমান: “আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে প্রত্যেক
নেক আমলের প্রতিদান কমপক্ষে দশগুণ হতে সাত শতগুণ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা বৃদ্ধি করে দেন। (প্রত্যেক আমলের ইখলাছ, লিল্লাহিয়্যাত, উপকার আর ফলাফলের ভিত্তিতে বদলা পাওয়া যায়); আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, কিন্তু রোযা এর ব্যতিক্রম, কেননা সেটা আমার জন্য এবং আমি নিজেই তার প্রতিদান দেব। (অন্য বর্ণনা মতে আমি নিজেই এর বদলা)। রোযাদার নিজের প্রবৃত্তির তাড়না ও আহার আমার কারণেই পরিত্যাগ করে রোযাদারের জন্য রয়েছে দু’টি আনন্দ ।
একটি ইফতারের সময়, অপরটি তার রবের সাথে সাক্ষাতের সময় অর্জিত হবে। রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশক থেকেও শ্রেয়। আর রোয়া হচ্ছে (শয়তানের হামলা প্রতিহত করার জন্য) ঢাল স্বরূপ । তোমাদের কেউ যেদিন রোযা রাখে, মহিলাদের সাথে যৌন সম্পর্কের কথাবার্তা বলবেনা । এবং অহেতুক শোরগোল করবেনা । যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় তবে একথা বলে দেবে যে, ‘‘আমি রোযাদার’’ (কিন্তু দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবেনা)”।
“আমি নিজেই তার বদলা দেব” এর মর্মার্থ :
প্রতিটি সৎকর্মের একটি উত্তম প্রতিদান আছে। আর রোযার প্রতিদান স্বয়ং মহান প্রভুই দিবেন । (অথবা তিনি নিজেই তার প্রতিদান হবেন) । কেননা, রোযাদার যখন ওই কাজগুলো প্রভুর সন্তুষ্টির জন্য ছেড়ে দিয়েছে, যেগুলোর ওপর তার জীবন নির্ভরশীল, সে যেন তার জীবনকেই বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে মহাপ্রভুর সান্নিধ্য পছন্দ করেছে। দরবারে ইলাহীতে প্রতেক আমলের প্রতিদান তার উপযুক্ত মতেই দেওয়া হয়ে থাকে। আল্লাহর ওপর এরূপ নির্ভরশীল ও খোদা প্রেমিকের
প্রতিদান এটাই হতে পারে, আল্লাহ তা’আলা তাকে সান্ত¡না দিবনে যে, যখন তুমি আমার হয়েছ, তো-আমি তোমার জন্য হয়ে গেলাম!
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর রা. হতে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ স. ফরমান, “রোযা আর কুরআন মানুষের জন্য (কিয়ামতের দিন) সুপারিশ করবে । রোযা বলবে হে আমার প্রভু, আমি তাকে দিনের বেলায় আহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ থেকে বিরত রেখেছি সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন, আর কুরআনে কারীম বলবে, আমি তাকে রাত্রে ঘুম থেকে বারণ করেছি, তাই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন । অতঃপর উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে।’’
শাফা’আতের স্বরূপ-:
যেই জগতেে আমরা বসবাস করছি তাকে ‘আলমে নাসুত