রামুতে ৪৫ ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালি উত্তোলন

  বিশেষ প্রতিনিধি    08-09-2022    94
রামুতে ৪৫ ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালি উত্তোলন

আওয়ামী লীগ-বিএনপির ৬০ নেতা জড়িত রামু উপজেলার বাঁকখালী, গর্জই খাল, বড় জাংছড়ি খাল ও খুনিয়াপালংসহ ৪৫টি স্পটে ড্রেজার ও স্কেভেটর বসিয়ে দিনরাত বালি উত্তোলন করছে আওয়ামীলীগ- বিএনপির অর্ধশত নেতাকর্মী। তাদের বেশিরভাগই সরকার দলীয় প্রভাবশালী নেতাকর্মী। তারা মানছেনা কোন আইন, নিয়মনীতি। ফলে ৩ খালই উভয়পাশে ব্যাপক ভাংগন দেখা দিয়েছে। রামু এসিল্যান্ড বলছেন আমরা অভিযান শুরু করেছি, তা চলবে নিয়মিত। এদিকে প্রশাসনের রহস্যজনক নীরবতায় এভাবে বালি উত্তোলনের কারণে এসব নদী ও খালের অনেক জায়গায় তীব্র ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। অবৈধভাবে, নির্বিচারে বালি উত্তোলনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। অনেকে বাঁকখালী নদীর চর ইজারা নিলেও অবৈধভাবে ড্রেজার-স্কেভেটর দিয়ে বালি উত্তোলন করে যাচ্ছেন। রামুর চাকমারকুল ইউনিয়নের নয়াপাড়া এলাকায় বাঁকখালী নদীর একটি স্পটেই বসানো হয়েছে ১০টি ড্রেজার মেশিন। সেখানে একাধিক স্কেভেটর দিয়ে উত্তোলনকৃত বালি পাচার করা হচ্ছে। রামু ফকিরা বাজারের আশপাশে অন্তত ৭টি ড্রেজার মেশিন ও একাধিক স্কেভেটর দিয়ে বালি উত্তোলন করে যাচ্ছেন রামু উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল হক চৌধুরী। অন্যতম মূলহোতা কলঘর বাজারের ফার্নিচার ব্যাবসায়ি জিয়াবুল সওদাগর। সরেজমিনে দেখা যায় রামুতে বাঁকখালী নদী, গর্জই খাল ও বড় জাংছড়ি খালে সরেজমিন গিয়ে ৩০ টি ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালি উত্তোলনের দৃশ্য দেখা গেছে। এরমধ্যে অধিকাংশ স্পটে ড্রেজার মেশিনের পাশাপাশি স্কেভেটর ব্যবহার করতে দেখা গেছে। সরেজমিন পরিদর্শনকালে সবচেয়ে বেশী ড্রেজার মেশিন দেখা গেছে- চাকমারকুলে ইউনিয়নের নয়াপাড়া এলাকায়। ওই এলাকায় ১০ টি ড্রেজার মেশিন রয়েছে। এসব ড্রেজার মেশিন বসিয়েছেন- স্থানীয় মৃত কবির আহমদের ছেলে চাকমারকুল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন সিকদার, মো. মোস্তফার ছেলে সাঈদ, আমির হামজা সিকদারের ছেলে নুরুল আমিন, মোহাম্মদ উল্লাহর ছেলে মো. কামাল, রশিদ আহমদের ছেলে মো. ছলিম ও মোক্তার আহমদের ছেলে মো. আলা উদ্দিন। ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নে বাঁকখালী নদীতে চলছে ৭টি ড্রেজার মেশিন। যার মধ্যে ৬টি ড্রেজারে বালি উত্তোলন করছেন- ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের লামারপাড়ার মৃত সুলতান আহমদ চৌধুরীর ছেলে রামু উপজেলা আওয়ামীলীগের অর্থ সম্পাদক নুরুল হক চৌধুরী। রামু ফকিরা বাজারের পূর্ব পাশে তিনি একাই ৫টি ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলন করছেন। এছাড়াও হাইটুপী ভুতপাড়া এলাকায় তিনি আরো একটি ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করছেন। ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের লম্বরীপাড়া আশুরঘাট সংলগ্ন এলাকায় বাঁকখালী নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করছেন- রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের উমখালী এলাকার আশরাফুজ্জামানের ছেলে বিএনপি নেতা দিদারুল আলম প্রকাশ দিদার বলী। উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নে ২টি স্পটে ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। এরমধ্যে কাউয়ারখোপ ফরেস্ট অফিসের দক্ষিণ পাশে ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করছেন- রামু উপজেলা আওয়ামীলীগের অর্থ সম্পাদক নুরুল হক চৌধুরী। একই ইউনিয়নের রাজারকুল-মনিরঝিল সংযোগ সেতুর পাশে বাঁকখালী নদীতে ড্রেজার ও স্কেভেটর দিয়ে বালি উত্তোলন করছেন- রামুর অফিসেরচর গ্রামের হামিদুর রহমানের ছেলে নুরুল আলম ও মন্ডলপাড়া গ্রামের সুলতান আহমদের ছেলে সুমন। গর্জনিয়া ইউনিয়নের ৪টি স্পটে ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করছেন ওই এলাকার সরকার দলীয় নেতাসহ একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। গর্জনিয়া গর্জই খালের রাজঘাট এলাকায় বালি উত্তোলন করছেন- ৪ জনের সিন্ডিকেট। এরা হলেন- গর্জনিয়া ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের বোমাংখিল গ্রামের ছলিম উল্লাহ চৌধুরীর ছেলে ইউপি সদস্য ও ছাত্রলীগ নেতা মারুফ, পশ্চিম বোমাংখিল গ্রামের রাজা মিয়া ওরফে মিডা রাজার ছেলে শেখ আবদুল্লাহ, বোমাংখিল গ্রামের বেলায়েত হোসেনের ছেলে গর্জনিয়া ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি হাফেজ আহমদ ও কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের তিতারপাড়া এলাকার ইসলাম চৌধুরীর ছেল যুবলীগ নেতা নাছির উদ্দিন সোহেল সিকদার। গর্জনিয়া ইউনিয়নের আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের পাশে গর্জই খালে ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করছেন ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের থোয়াংগেরকাটা এলাকার আমির হামজার ছেলে ইউপি সদস্য আবদুল জব্বার। এ ইউনিয়নের পূর্ব বোমাংখিল শর্মা পাড়ায় বাঁকখালী নদীতে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালি উত্তোলন করছেন- পূর্ব বোমাংখিল গ্রামের মৃত রবিউল আলমের ছেলে তানজিদ রায়হান। গর্জনিয়া রাজঘাট এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান- ইউপি সদস্য মারুপ, যুবলীগ নেতা হাফেজ আহমদ, আবদুল্লাহ ও সোহেল সিকদার ২টি ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করে যাচ্ছেন। চক্রটি ড্রেজার বসিয়ে রাজঘাট নামক স্থানে কয়েকটি বিশাল বালির স্তুপ করে আবার ড্রেজারগুলো নিয়ে যান। স্তুপকৃত বালি বিক্রি শেষ হলে আবার ড্রেজার গর্জই খালে বসিয়ে বালি উত্তোলন শুরু করে। দীর্ঘদিন একটি ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলন করলেও চক্রটি সম্প্রতি নতুন একটি ড্রেজার ক্রয় করেছে। বর্তমানে দুটি ড্রেজার দিয়ে তারা বালি উত্তোলন করছে। উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের বড় জাংছড়ি খালের ৪টি স্পটে ড্রেজার বসিয়ে বিরামহীনভাবে চলছে বালি উত্তোলন- এরমধ্যে টেকপাড়া এলাকায় ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করছেন- মৌলভীরকাটা এলাকার সাবেক মেম্বার পিয়ার মোহাম্মদের ছেলে যুবলীগ নতো জহির ইসলাম, শুকমনিয়া এলাকায় ড্রেজারে বালি উত্তোলন করছেন- কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের হাজ¦ীপাড়া এলাকার মোস্তাক আহমদের ছেলে রাসেল, কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের গর্জনিয়া বাজার গরু বাজারের পাশর্^বর্তী দুটি স্পটে ড্রেজার মেশিনে বালি উত্তোলন করছেন- পশ্চিম তিতারপাড়া এলাকার গুনু মিয়ার ছেলে লোকমান হাকিম ও তিতারপাড়া এলাকার আবু তাহের (ব্লাক তাহের) এর ছেলে মেহেদী হাসান। উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের মোক্তারবাপের পাড়া উমখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন বাঁকখালী নদীতে ২টি ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করছেন- রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের উমখালী এলাকার আশরাফুজ্জামানের ছেলে বিএনপি নেতা দিদারুল আলম প্রকাশ দিদার বলী। অপরদিকে খুনিয়াপালং ইউনিয়নের অবস্থা আরো শোচনীয়। সেখানে জাতীয় পার্টির রামু উপজেলা সাধারণ সম্পাদক নামধারী স্থানীয় দক্ষিন খুনিয়া পালংয়ের আজিজুর রহমানের পুত্র সরওয়ার ইসলামের সিন্ডিকেটের রয়েছে অসংখ্য ড্রেজার। তার সরাসরি তত্বাবধানে ড্রেজার চলছে মধ্যম খুনিয়াপালং এটিএম জাফর আলম মাল্টি মিডিয়া একাডেমী সংলগ্ন খালে ২ ড্রেজার। মধ্যম খুনিয়া জমিরাকাটায় সেই বালুদস্যু সরওয়ার ইসলাম ও সাহাব উদ্দীনের ছেলে শাহজাহান এর নেতৃত্বে ২টি ড্রেজারে পাহাড়ি খালের বালু ও পাহাড় উজাড় করছে। পশ্চিম মধ্যম খুনিয়ায় বিশ্ব ব্যাংকের বাগানের ভেতরে ছরায় স্থানীয় ফজল করিমের ছেলে আবদু রাজ্জাক ও আবদুর রহমানের ছেলে কামাল উদ্দিন প্রকাশ ডেপা কামালের নেতৃত্বে ড্রেজার চলছে ২টি। এছাড়া পরিবেশ সংকটাপন্ন ইসিএ এলাকা দক্ষিন গোয়ালিয়া টাইংগাকাটায় ব্রীজে গোড়া ও আবদুর বাড়ি এলাকায় ২টি ৫০ অশ্ব সম্পন্ন ড্রেজার বসিয়েছে। ধোয়া পালং এলাকার আবদুর রহিমের পুত্র কামাল উদ্দিন, নজির আহমদের পুত্র আ.লীগ নেতা সোহারাব ও বিএনপি নেতা এনামের সিন্ডিকেট। টাইংগাকাটা ছড়াটি গেজেটভুক্ত ইসিএ এলাকা হওয়ার পরও সেখানে পরিবেশের মারাত্নক ক্ষতি করে হাজার হাজার গাড়ি বালি উত্তোলন করা হয়েছে। এছাড়া ধোয়া পালং রেঞ্জের ২০০৫ সালের ২য় আবর্তের সামাজিক বাগানে সরকারী বনভুতিতে পাহাড় ভেঙ্গে কামাল উদ্দিন, সোহরাব, মিল নুরু, মালেক কোম্পানী সহ ইউপি চেয়ারম্যান সিন্ডিকেট হাজার হাজার পিক আপ বালি উত্তোলন করছে ২টি ড্রেজার বসিয়ে ৬টি পাহাড়, শত শত গাছপালা উজাড় করে। দারিয়ারদিঘী এলাকার মাহাবুব জানান,গত ৫০ বছরে এখানে ড্রেজার বসানো হয়নি। অথচ গত ৬-৭ মাস ধরে ধোয়াপালং এর রহিমের ছেলে কামাল, নজির আহমদের ছেলে সৌরভ, ধেছুয়া পালং এর আবদুর রহিমের ছেলে আহমদুল করিম রুবেল সিন্ডিকেট করে এখানো ৩টি ড্রেজার বসিয়েছে। রামু উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভুমি) নিরুপম মজুমদার জানান- বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযান শুরু করেছি। আজকেও নুরুল হক চৌধুরীকে বালু উত্তোলনের দায়ে ১ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছি। পর্যায়ক্রমে চিহ্নিত সবখানে অভিযান জোরদার করা হবে। রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা মুস্তফা জানান- আমি এবং এসিল্যান্ড নতুন। আৃরা অভিযান শুরু করেছি বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে। এটি চলমান থাকবে। সকলের সহযোগিতায় পরিবেশ বিপর্যয় এবং আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য আমরা সচেষ্ট আছি। বালু উত্তোলন এবং মাটি,পাহাড়কাটায় জড়িতদের কেউ রেহায় পাবেনা।

সারাদেশ-এর আরও খবর