নারীর অসুস্থতা ও পারিবারিক সহমর্মিতা

নাজমুন নাহার হেলেন

  বিশেষ প্রতিনিধি    19-02-2023    218
নারীর অসুস্থতা ও পারিবারিক সহমর্মিতা

একজন নারী তার কর্মদক্ষতায়, সেবায়, প্রেরণায়, চেহারায় আনন্দে-কলহাস্যে পরিবার তার চারপাশ আগলে রাখবে। এটাই যেন চিরায়ত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সেই নারীর শারীরিক অসুস্থায় অনেক পরিবারের লোকজন তেমন গুরুত্ব দেয় না বা ব্যাপারটা ঝামেলার মনে করেন। বহুবিধ কারণে নারীরা গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন, যেমন বাল্যবিবাহের শিকার, অপুষ্টি, রক্তস্বল্পতায় ভোগা, অল্পবয়সী গর্ভবতী। তা ছাড়া প্রসূতিদের এসব ক্ষেত্রে প্রসব-পরবর্তী জটিলতাও অত্যন্ত বেড়ে যায়। প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ প্রসূতির মৃত্যুর একটি বড় কারণ। পরে বয়স বাড়লে জরায়ুমুখের ক্যানসার, টিউমারসহ বিভিন্ন জটিল রোগের ব্যাপারেও দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণে সংকোচ ও অনীহা দেখা যায়। এতে জটিলতা বেড়ে যায় বহুগুণ। অস্টিওপরোসিসসহ মেনোপজকেন্দ্রিক সমস্যাগুলোও সঠিক চিকিৎসার ফলে নিয়ন্ত্রণযোগ্য।

পরিবারে নারীর অসুস্থতাকে প্রায় সময়ই অবহেলার চোখে দেখা হয় বলেই তাদের চিকিৎসা শুরুই হয় দেরিতে, ফলে রোগের জটিলতা বেড়ে যায়। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়াও নারীর চিকিৎসায় গুরুত্ব না পাওয়ার একটি বড় কারণ। ডাক্তারের কাছে যায় শেষ সময়। আজকাল নারীদের জরায়ু ও ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্তের হার বেশি। এসব সেনসেটিভ জায়গায় ক্যানসার হওয়ার কারণে বেশিরভাগ নারী লজ্জায় বলতে চায় না। আবার বললেও ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। এ ছাড়া ক্যানসার দুরারোগ্য, এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার কারণে সে পরিবারের বোঝা হবে ভেবেও বলতে দেরি করে। অনেক ক্ষেত্রে এত দেরি করে ফেলে যে, চিকিৎসার আর সময় থাকে না।

আবার এসব রোগে আক্রান্ত হলে পরিবারের লোকজন যে সব সময় সহৃদয়তা দেখায় এমনো নয়। ক্ষেত্র বিশেষে প্রথম প্রথম চিকিৎসা করালেও পরে হাল ছেড়ে দেয়। রোগীর প্রতি চরম অবহেলা দেখায়, এর ফলে রোগী মনোবল হারিয়ে ফেলে। অথচ আমরা জানি যে, যে কোনো রোগে শারীরিকের সঙ্গে মানসিকভাবে রোগীর সুস্থ থাকা জরুরি। রোগী আর্থিকভাবে সচ্ছল হলে তবু তার চিকিৎসা চলে বা তার নিকট-স্বজনরা কিছুটা কেয়ার করে, তবে অসচ্ছল হলে কিংবা স্বামীর ওপর নির্ভরশীল হলে সেই নারীর রোগে আর অবহেলায় জীবন নরক হয়ে ওঠে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, যে কোনো রোগে সবচেয়ে আগে নারী ও শিশুরাই আক্রান্ত হয়। আর বাস্তবতা হলো যে কোনো রোগেশোকে নারীরাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত থাকে।

এ ছাড়া পিরিয়ডের আগে আগে বিরক্ত লাগা, মেজাজ খারাপ, বিষণ্নতা, শরীরে পানি আসা, স্তনের প্রদাহ, অস্থির লাগা, মাথাব্যথা ইত্যাদি নারীদের একটা কমন সমস্যা। এসব সমস্যা কয়েকটি হরমনের কমবেশির কারণে হয়ে থাকে। এ সময়টাতেও নারীর মানসিক বিষণ্নতাকে পরিবারের নিকটজনরা বুঝতে চান না। অথচ এ সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করার জন্য একটি অত্যন্ত ভালো ও সুশৃঙ্খল জীবনপদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। নিয়মিত ও পর্যাপ্ত ঘুম, সঠিক সময়ে পুষ্টিকর ও সুষম খাবার গ্রহণ, ব্যায়াম, পর্যাপ্ত পানি পান ছাড়াও এসবের কিছু চিকিৎসা রয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথানাশক ও জন্মনিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ওষুধে এসব সমস্যার প্রতিকার সহজেই মেলে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ও অতিরিক্ত সমস্যা দেখা দিলে পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রেও দেখা যায় নারী নিজেই অসচেতন অথবা তার পরিবারের চরম অবহেলা।

অসুস্থতা ছাড়াও নারীর ইচ্ছা, স্বাধীনতা, ব্যক্তিত্ব, চাকরি, ব্যবসা সব ক্ষেত্রেই তাকে দমিয়ে রাখার একটা কমন প্রবণতা তো আছেই। নারী পুরুষের অধীন এই কনসেপ্ট থেকেই দমনপীড়নের শুরু। নারীদেরই জন্মনিয়ন্ত্রণের সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। জন্মনিয়ন্ত্রণের যত পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই নারীর জন্য। পুরুষের জন্য হাতেগোনা কয়েকটি। বার্থকন্ট্রোল পিল খেলে অনেক নারীর হরমন ইমব্যালান্স হয় অথবা তার স্কিনে প্রবলেম হয়। তার পরও নারীকেই এই পিল খেতে হয়। অনেক সময় চাইলেও গর্ভনিরোধ করার অধিকার পায় না অনেক নারী, ফলে অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ মেনে নিতে হচ্ছে তাদের। জরিপে দেখা যায়, দেশের ৩০ শতাংশ নারী কখনো প্রজননসংক্রান্ত সমস্যায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না।

নারীর শারীরিক অসুস্থতা বা অবহেলার বিবিধ সমস্যা সমাধানের জন্য কন্যাশিশুর পুষ্টি, বাল্যবিবাহ রোধ, নারী শিক্ষা লাভের অধিকার এসব বিষয় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রজননের অধিকারের বিষয়গুলোতে নিজে সিদ্ধান্ত দিতে পারা, সব ক্ষেত্রেই নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সচেতনতা ও নারীর অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া অতীব জরুরি।

তথ্য সূত্র : ইন্টারনেট

মুক্তমত-এর আরও খবর