প্রথমবারের মতো ঘূর্ণিঝড়ের মুখোমুখি কক্সবাজারের মাতারবাড়ীর মেগা প্রকল্পগুলো

  বিশেষ প্রতিনিধি    13-05-2023    95
প্রথমবারের মতো ঘূর্ণিঝড়ের মুখোমুখি কক্সবাজারের মাতারবাড়ীর মেগা প্রকল্পগুলো

কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের (জাইকা) সহায়তায় নির্মাণাধীন এ প্রকল্পের বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বন্দর নির্মাণকাজের ভৌত অগ্রগতি ৯১ শতাংশের বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত বাকি প্রকল্প মিলিয়ে ৭৩ শতাংশ সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়াও মাতারবাড়ীতে এলএনজি টার্মিনাল, এলপিজি টার্মিনাল, ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল, সমুদ্রবন্দর, গভীর সমুদ্রবন্দরসহ ৩৭টি মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। মাতারবাড়ীতে চলমান কোনো অবকাঠামোর কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও প্রথমবারের মতো ঘূর্ণিঝড় মোখার মতো বড় ধরনের সাইক্লোনের মুখোমুখি হচ্ছে এ অঞ্চলের মেগা অবকাঠামোগুলো।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় শেষ হওয়া মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য অবকাঠামোয় সাইক্লোন মোখার প্রভাব কতটা প্রবল হবে তা এখন দেখার অপেক্ষায়। যদিও সাইক্লোনের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রতিরোধের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এখানকার মেগা অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।

মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। বর্তমানে কেন্দ্রের কমিশনিং-সংক্রান্ত নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ চলছে। তবে এর সঙ্গে আরো বেশ কয়েকটি প্রকল্পের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

এসব প্রকল্পের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। প্যাকেজ ১ ও ২-এর আওতায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বন্দর নির্মাণ, চ্যানেল রিভেটমেন্ট, সেডিমেন্ট মিটিগেশন ডাউক, সিওয়াল নির্মাণ এবং ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।

তারা বলছেন, বর্তমানে কেন্দ্রের পাওয়ার হাউজ, বয়লার, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও ফ্যাসিলিটিজের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। এর আগে মাতারবাড়ীর বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে চকরিয়া-মাতারবাড়ী ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন ও মাতারবাড়ী ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়।

ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন (ইপিসি) ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে জাপানের সুমিতোমো করপোরেশন, তোশিবা করপোরেশন ও আইএইচআই করপোরেশনের কনসোর্টিয়াম।

ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র কতটা ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) নির্বাহী পরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ইপিসি ঠিকাদার কাজ করছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারাই যাবতীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। অবকাঠামোগুলো এখনো আমরা বুঝে পাইনি, সেজন্য এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না।’

ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে মাতারবাড়ীর মেগা অবকাঠামোয় ক্ষয়ক্ষতি কিংবা আশঙ্কার বিষয়গুলো একেবারেই উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান এবং পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রোগ্রামের পরিচালক ড. মো. মনিরুজ্জামান।

তিনি বলেন, ‘সাইক্লোনে তিন ধরনের ব্যাপার থাকে। ভারি বৃষ্টিপাত, বজ্রপাত ও জলোচ্ছ্বাস। এ তিনটি মিলেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ে। এবার প্রথমবারের মতো মাতারবাড়ীর বড় অবকাঠামোগুলো এত বড় সাইক্লোনের মুখোমুখি হচ্ছে। এর ফলে কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে কিংবা কীভাবে মোকাবেলা করা হবে তা এখন দেখার অপেক্ষা। মাতারবাড়ী ছাড়াও কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ ভাঙন ও ডেবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। এ বিষয়টিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।’

ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই মাতারবাড়ীর মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ এগিয়ে চলছে বলে জানিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র। সূত্র জানায়, প্রকল্প এলাকায় তিন স্তরের নিরাপত্তা বাঁধ দেয়া হয়েছে। প্রতিটি বাঁধই জলোচ্ছ্বাসের সময় সর্বোচ্চ পানির উচ্চতা পরিমাপ করে নির্মাণ করা হয়েছে। এখন ঘূর্ণিঝড়ের পর বোঝা যাবে আসলে প্রস্তুতি কতটা যথার্থ ছিল।

যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণের আগে যেহেতু পরিবেশগত সব বিষয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা করা হয়, সে হিসেবে মাতারবাড়ীতে নির্মিতব্য অবকাঠামোয় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বড় আকার ধারণ করবে না বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক ড. দিলারা জাহিদ।

তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি মেগা অবকাঠামোগুলো পরিবেশগত সমীক্ষা করে পরিবেশ অধিদপ্তরের মানমাত্রা মেনেই করা হয়েছে। তাই সেখানে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা কম। তবে গত ৩০-৪০ বছরে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী এলাকায় এত বড় ঘূর্ণিঝড় হতে আমরা দেখিনি।

ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতিও কম। সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতাও আমরা কম দেখেছি। অবকাঠামোর ব্যাপারে বলব, সামনে যে অবকাঠামোগুলো নির্মাণ হবে সেগুলোও যেন ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগ বিবেচনায় রেখেই নির্মাণ করা হয়। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামীতে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।’

সারাদেশ-এর আরও খবর