আসন্ন নির্বাচন সংঘাত নয়, আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য হওয়ার আহ্বান রাষ্ট্রপতির

  বিশেষ প্রতিনিধি    08-04-2023    99
আসন্ন নির্বাচন সংঘাত নয়, আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য হওয়ার আহ্বান রাষ্ট্রপতির

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। ক্ষমতায় যাওয়া বা পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় নির্বাচন। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি কখনো দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। বরং তা রাজনৈতিক পরিবেশকে তমসাচ্ছন্ন করে তোলে। সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে আমাদের সবার সহায়তা করা উচিত। রাজনীতি থেকে হিংসা-হানাহানি অবসানের মাধ্যমে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মহান সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশের জনগণ নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ ও বেগবান করবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।

জাতীয় সংসদের ৫০ বছর উপলক্ষে শুক্রবার (৭ মার্চ) সংসদে দেওয়া এক বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি। এসময় সংসদে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদসহ অধিকাংশ সংসদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

আবদুল হামিদ বলেন, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলে। দেশে গণতন্ত্র অব্যাহত থাকলে উন্নয়ন ও অগ্রগতি এগিয়ে যায়। আবার গণতন্ত্রের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হলে উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়। উন্নয়নকে স্থায়ী ও টেকসই করতে হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মজবুত করতে হবে, তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে। গণতন্ত্রহীন অবস্থায় যে উন্নয়ন হয় তা কখনো সার্বজনীন হতে পারে না। সে উন্নয়ন হয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক।

তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এর পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীলতা এবং দৈনন্দিন নাগরিক জীবনের জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এটাই আশা করে জনগণ। সমাজের সব স্তরের নাগরিক, বিভিন্ন গোষ্ঠী, দল, সংগঠনের চাওয়া-পাওয়া ও স্বার্থকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমন্বয়সাধন করতে হয় জাতীয় সংসদকে। সংসদ সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। জনগণ অনেক আশা নিয়ে আপনাদের নির্বাচিত করেছেন যাতে তাদের কথা, চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা আপনারা সংসদে তুলে ধরেন। এটা আপনাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক মতপার্থক্য এবং নীতি-আদর্শের ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু সংসদকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে কোনো ভিন্নতা থাকতে পারে না। তাই আপনাদের প্রতি আমার আকুল আহ্বান সংসদকে কার্যকর করতে ঐক্যবদ্ধ হোন। আমাদের অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জাতীয় সংসদে সবস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এটি অর্জনে আমাদের সবসময় সচেষ্ট থাকতে হবে।

দুনিয়ার পার্লামেন্টারি কনভেনশনে যেসব নীতিমালা আছে, সেগুলো আমরা মেনে চলতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে যেন এমন একটি সংসদীয় পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারি, যাতে সবাই আমাদের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে। এখানে কোনো দল বা মতের নয়- এখানে এ দেখবো যে প্রত্যেক সদস্য যার যে অধিকার আছে, সে অধিকার ব্যবহার করতে পারেন। সেদিকে আপনিও (স্পিকার) খেয়াল রাখবেন বলে আমি করি। এ সম্পর্কে আপনি আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন।

তিনি বলেন, পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে স্পিকার অনেক সময় বিব্রত হতেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু হতেন না। ১৯৭৩ সালে পার্লামেন্টে আতাউর রহমান খান, এমএন লারমাসহ বিরোধীদলের কয়েকজন এমপি ছিলেন। তখনও দেখেছি তারা কথা বলতে চাইলেই সুযোগ পেতেন এবং বঙ্গবন্ধুই স্পিকারকে বলে সে সুযোগ করে দিতেন। এটা ছিল বিরোধীদলকে আস্থায় নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর একটি গণতান্ত্রিক কৌশল। রাজনৈতিক মতাদর্শের যত অমিলই থাকুক না কেন বঙ্গবন্ধু বিরোধীদলের নেতাদের যথাযথ সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। আসলে রাজনীতিতে শিষ্টাচার ও পরমত সহিষ্ণুতার কোনো বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। সংসদে সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের সমর্থন ও মতামতের ওপর নির্ভরশীল। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কার্যক্রম তদারকির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ‘নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য’ প্রতিষ্ঠা করা সংসদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। দক্ষ ও নিবিড় তদারকির মাধ্যমে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা সংসদকে অধিক কার্যকর করে যা চূড়ান্তভাবে সামগ্রিক জনকল্যাণকেও নিশ্চিত করে। এক্ষেত্রেও একজন সংসদ সদস্য ব্যক্তিগত কিংবা সমষ্টিগতভাবে জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে সন্নিবেশিত বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে সংসদের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারেন।

গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানিযোগ্য কোনো পণ্য বা সেবা নয়। মনে চাইলো কোনো দেশ থেকে পরিমাণমত আমদানি বা রপ্তানি করলাম, বিষয়টি এমন নয়। চর্চার মধ্যদিয়ে গণতন্ত্র বিকশিত ও শক্তিশালী হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সংসদের কার্যবাহে সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যগুলো পড়লে বুঝা যায় সংসদকে কীভাবে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করতে হয়।

পরমতসহিষ্ণুতা, বিরোধীদলকে আস্থায় নেওয়া এবং অন্যকে কীভাবে সম্মান দেওয়া যায় এসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় নজির রেখে গেছেন। আমাদের সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধুর মতো একজন বিশ্বমানের কিংবদন্তি নেতা পেয়েছিলাম। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা তাকে ধরে রাখতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু তার নীতি-আদর্শ আমাদের চিরন্তন প্রেরণার উৎস। তার দেখানো পথেই আমাদের এগিয়ে নেবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় ও যোগ্য নেতৃত্বে বিগত দেড় দশকে দেশের প্রতিটি সেক্টরে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সত্ত্বেও বিশ্বে যে কয়েকটি দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে সরকারের আর্থসামাজিক ও বিনিয়োগধর্মী নানামুখী প্রকল্প, কর্মসূচি এবং কার্যক্রম গ্রহণের ফলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণ, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। দারিদ্র্যের হার কমার পাশাপাশি মাথাপিছু আয় বেড়েছে।

দেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী দেশে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও দেশের খাদ্যনিরাপত্তা সুরক্ষিত রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতির মূলধারায় ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল মানুষকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আশ্রয়ণ, ভূমিহীনদের মধ্যে খাস জমি বিতরণ ও কর্মসংস্থান প্রভৃতি কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীন বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। কদিন আগেও প্রায় চল্লিশ হাজার ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ২১১টি উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে এবং ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২’ উৎক্ষেপণের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। দেশের সক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে এবং ঢাকায় মেট্রোরেল চালু করা হয়েছে। পায়রা বন্দরকে গভীর সমুদ্রবন্দর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল ও রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজও নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, গণতন্ত্র চর্চার প্রাণকেন্দ্র জাতীয় সংসদ। সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সরকারের সব বিভাগের জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে আদর্শ স্থাপনের গুরুদায়িত্ব বর্তায় সংসদ সদস্যদের ওপর। কেবল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিতরাই সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্ব এবং জনগণের নিকট জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারেন। এ বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী উভয়পক্ষের সংসদ সদস্যগণই জাতির নিকট দায়বদ্ধ। এ উপলব্ধি থেকে হিংসা-বিদ্বেষ, ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে আমি সংসদ সদস্যদের গঠনমূলক, কার্যকর ও সক্রিয় অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।

লখো সূর্যসন্তান তাদের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ উপহার দিয়ে গেছেন। আমাদের দায়িত্ব এ দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ এ মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে আমি আজ দলমত নির্বিশেষে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি- আসুন, সবার সম্মিলিত প্রয়াসে প্রিয় মাতৃভূমি থেকে সংঘাত-সংঘর্ষ এবং যেকোনো উগ্রবাদ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড হতে দূরে থেকে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে শামিল হই। গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলে এমন যেকোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।

তিনি বলেন, হিংসা-বিভেদ নয়, স্বার্থের সংঘাত নয়- আমাদের সামনে রয়েছে আজ দেশ গড়ার কাজ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা গড়ে দিয়ে যাবো একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এ হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার।

জাতীয়-এর আরও খবর