বৈঠক বাতিলে ইয়াহিয়ার ঘোষণা কীসের ইঙ্গিত দিয়েছিল?

  বিশেষ প্রতিনিধি    22-03-2023    153
বৈঠক বাতিলে ইয়াহিয়ার ঘোষণা কীসের ইঙ্গিত দিয়েছিল?

১৯৭১ সালের ২২ মার্চ ছিল সোমবার। সকাল সাড়ে ১১টায় বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনা করেন। ২৫ মার্চ আবারও বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও ওই দিন (২২ মার্চ) সন্ধ্যায় এসে বৈঠক বাতিলের বিবৃতি পাঠানো হয়। সেদিন ভুট্টো এবং ইয়াহিয়ার আচরণে জনমনে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ কোনও কারণে কালক্ষেপণ করতে চায়। পরবর্তীকালে গবেষকরা বলেছেন, টাইমলাইন খেয়াল করলে বোঝা যায়, আসলে আলোচনার আড়ালে ইয়াহিয়া কালক্ষেপণ করে গণহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

২২ মার্চ প্রায় ৭৫ মিনিটব্যাপী আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়চিত্তে প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে আসেন এবং অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার নির্ধারিত বৈঠক ছিল। সে অনুযায়ী আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে যাই। সেখানে মি. ভুট্টো উপস্থিত ছিলেন। আমি প্রেসিডেন্টকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি যে ৪টি শর্ত পূরণ না হলে আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে পারি না।’

সেদিন দুপুরে বাসায় ফিরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আরেক দফা কথা বলতে হয় বঙ্গবন্ধুকে। তিনি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, ‘ইতোমধ্যে বাংলাদেশে গুরুতর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জনগণের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’

এদিন বিদেশি টেলিভিশনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের নির্বাচিত বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে শাসন করার নৈতিক বৈধতা কেবল আমারই রয়েছে, অন্য কারও নয়।’

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ২২ মার্চের ঘটনা নিয়ে প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল—‘ভুট্টোর উপস্থিতিতে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক’। শিরোনামের নিচে উল্লেখ করা হয়, ‘সংকট নিরসনের পথে?’ মূল প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিক্ষুব্ধ বাংলার ১০ দিগন্তে মুক্তিকামী গণমানুষের একটানা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমিতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বুকে রাজনৈতিক পর্যায়ে পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারণের প্রশ্নে বোঝাপড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আকস্মিকভাবে স্থগিত ঘোষণা এবং পরবর্তী ঘটনাবলির অপরিহার্য পরিণতি হিসেবে যে চরম রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, বাংলার জনগণের পক্ষ থেকে শেখ মুজিব কর্তৃক উত্থাপিত ৪ দফা দাবি পূরণের মধ্য দিয়ে তা অবসানের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিন ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার অষ্টম কলামে প্রকাশিত হয় ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত’। খবরে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান আগামী ২৫ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছেন। ২২ মার্চ দুপুর ১২টায় মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে সমবেত সাংবাদিকদের প্রতি প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র এ তথ্য জানান। তবে প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় জাতীয় পরিষদ অনুষ্ঠানের পরবর্তী দিনক্ষণ প্রসঙ্গে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। এদিন সন্ধ্যায় সংবাদপত্রে প্রেরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছেন, ‘পাকিস্তানের উভয়াংশের নেতারা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে সমঝোতার ক্ষেত্র অধিকতর প্রসারিত করার সুবিধার্থে ২৫ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হলো।’ পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন কবে বসবে— এ রকম কোনও দিন তারিখ উল্লেখ না করেই বিবৃতিটি প্রদান করা হয়।

লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের ২১তম দিবস শেষ হয়। প্রতিদিনের ন্যায় সেদিনও বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঢেউয়ের মতো একের পর এক শান্তিপূর্ণ ও নিয়মানুগ মিছিলের স্রোত আসতে থাকে। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মিছিলের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বুলেট এবং বেয়নেটের মাধ্যমে যত ষড়যন্ত্রই চলুক না কেন, সমগ্র বাংলাদেশ আজ জাগ্রত, বাঙালি জাতি আজ একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অবিচল ও ঐক্যবদ্ধ। সুতরাং, জয় আমাদের সুনিশ্চিত।’

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর মনে করেন, আলোচনার শেষ দিকে এক ধরনের গড়িমসি লক্ষ করা যায়। আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে তাদের নানা রকমের শর্ত ও বিভিন্ন নেতিবাচকতাকেই সামনে রেখেছেন। ফলে শেষের দিকে তাদের উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার হতে শুরু করলেও তারা যে এত বড় গণহত্যার পরিকল্পনা তলে তলে করেছে, সেটা স্পষ্ট হয়নি। কিন্তু ২২ তারিখ হুট করে ২৫ তারিখের আলোচনা স্থগিত করার মধ্যে এক ধরনের আভাস পাওয়া যায়।’

জাতীয়-এর আরও খবর