দুঃখবিলাসের গল্প থেকে মহাকাব্যের কুর্নিশময় চরিত্র

  বিশেষ প্রতিনিধি    02-03-2023    222
দুঃখবিলাসের গল্প থেকে মহাকাব্যের কুর্নিশময় চরিত্র

২০১৪ সালের ১৩ জুলাই। ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়াম। লাতিন ফুটবলের শোকেসে আরেকটি ট্রফি সাজানোর মঞ্চ প্রস্তত। আকাশি-সাদায় ছেঁয়ে গেছে গ্যালারির বেশিরভাগ। আরেকবার নায়ক হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরো। ঠিক এই সময়ই যেন বাজ পড়লো মারাকানায়!

৯০ মিনিটের মহাদ্বৈরথ শেষে চলছে অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের দামামা। সাতটা মিনিট কেবল দূরে, ঠিক তখনি ডি-বক্সের বামপ্রান্তে বাজরূপে উদয় হলেন মারিও গোৎসে। খানিকটা এগিয়ে এসেছিলেন রোমেরো। এই সুযোগে দুর্দান্ত চিপ শটে ঢেউয়ের মতো জাল কাঁপালেন। সেই সঙ্গে কেঁপে উঠল অযুত-নিযুত আর্জেন্টাইন ও তার সমর্থকদের হৃদপিণ্ড। শুরু হলো লিওনেল মেসি নামক এক জাদুকরের দুঃখবিলাসের করুণ গল্প।

ক্লাব ক্যারিয়ারে ৭০০ গোল, ক্লাব ক্যাবিনেটে সব ধরনের শিরোপা, ব্যক্তিগত ভাণ্ডারে অর্জনের ছড়াছড়ি। সব মিলিয়ে মেসি হয়ে গিয়েছিলেন ফুটবলের কিংবদন্তি। তবে তার নামের পাশে এই কিংবদন্তি শব্দটা নিয়ে শুরু জোর আপত্তি। হায়! দেশের হয়ে ক্ষুদে জাদুকরের ভাণ্ডার যে শূন্য! একরাশ আক্ষেপ-হতাশা-বিষাদময় সময় হলো তার দিনরাতের সঙ্গী।

মেসির দুঃখবিলাসের এই সময়টা দীর্ঘ হলো অর্ধযুগ। ২০১৪ সালের ওই হারের পর ২০১৮-তেও বিশ্বমঞ্চে আরেকবার স্বপ্নভঙ্গ। তবে চূড়ান্ত আঘাতটা মেসি পেয়েছিলেন মাঝের সময়টায়, ২০১৬ সালে কোপা আমেরিকায়। হতাশায়, দুঃখে জাতীয় দলের জার্সিটাও তুলে রাখতে চেয়েছিলেন লিও। কিন্তু পারলেন না, ফিরে আসলেন নতুন স্বপ্নের আশায়।

কেমন ছিল সেই স্বপ্ন? হতাশায় ভেঙে পড়া মেসি নিজেই হয়ে উঠলেন নিজের সান্ত্বনা। ঘুরে দাঁড়ালেন, ভেঙেচুরে দলটাকেও গড়লেন নিজের মতো। একঝাঁক প্রতিভাবান তরুণ, যাদের অনেকেরই আইডল মেসি; তারা হয়ে উঠলেন মেসির দিবারাত্রীর ছায়া। হয়ে উঠলেন বিশাল এক আকাশ। যে আকাশ থেকে ঝরলো একের পর পর শীতল বৃষ্টিকণা।

লিওনেল স্কালোনি নামক এক মাস্টারের মন্ত্রে বদলে গেল পুরো দল। মেসির দুঃখবিলাসের গল্পের বইতে লাগলো সুখের হিমেল বাতাস। একের পর এক জয়ের স্রোতে হারাতে লাগলো দুঃখের যত চোরাবালি। দেখতে দেখতে চলে এলো দক্ষিণ আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের আরেকটা আসর, আরেকটা কোপা আমেরিকা।

২০১৯ সালের আসরে সেমিফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হারের পর টানা ২০ ম্যাচ অপরাজিত থেকে ২০২১ সালে আবারও কোপার মঞ্চে পা রাখে আর্জেন্টিনা। ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে ২৮ বছর পর কোনো শিরোপা ঘরে তুলে আলবিসিলেস্তেরা। শুরু হয় মেসির চূড়ান্ত সুখবিলাসের গল্প। কাতারে ৩৬ বছরের আক্ষেপ ঘুচিয়ে মেসি হয়ে উঠলেন কুর্নিশময় এক চরিত্র।

এরপর থেকে মেসি-বন্দনায় মাতোয়ায় পুরো বিশ্ব। কট্টর সমালোচক থেকে ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী; সবাই যেন মোহাবিষ্ট হয়ে রইলেন সর্বজয়ী চরিত্রের মাঝে। পায়ের জাদু থেকে দু’হাত তুলে উদযাপন; সবটাই হয়ে রইলো মহাকাব্যের সুখপাঠ্য।

আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের দুঃখ যিনি ঘোচালেন, প্রাপ্তি আর অর্জন পদতলে লুটিয়ে পড়বে, এই তো নিয়ম। সুখপাঠ্যের অধ্যায়টা তাই বিশ্বজয়েই শেষ হয়নি। আরেকটু বাকি ছিল, বাকি ছিল সেরা ফুটবলারের পুরষ্কার। সেটাও তার হাতে এসে ছড়িয়ে দিলো আলোর বিচ্ছুরণ। ঝলমলে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল শিল্প-সাহিত্যের প্যারিস নগরী।

২০২২ সালের ‘ফিফা দ্য বেস্ট’ পুরস্কার হাতে মেসির হাসি স্মরণ করিয়ে দিলো ২০১৬ এর অবিশ্রান্ত কান্নার মুহূর্ত। সেই থেকে এই; দুঃবিলাসের গল্প থেকে মেসি হয়ে উঠলেন মহাকাব্যের কুর্নিশময় এক চরিত্র।

এমবাপ্পে, যে ছেলে মেসিকে ড্রেসিংরুমে শুরুতে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতো; কাতারের ঐ আনন্দ উৎসবের পর সেও মেসিতে মুগ্ধ হয়ে গেল। মেসিকে পাস দিতে যার মনের সঙ্গে পা’টাও খানিকটা দ্বিধায় থাকতো, সেই এমবাপ্পে সেরার মঞ্চে মেসির পিঠ চাপড়ে দিলেন। দিনশেষে, ইনস্টাগ্রামে ভাসে গৌরবের ছলাৎ ছলাৎ শব্দের অপরূপ ধ্বনি, ‘মেসি ইউ আর দ্য বেস্ট।’

খেলাধুলা-এর আরও খবর