মোশাররফের রাজত্ব কার দখলে যাচ্ছে

  বিশেষ প্রতিনিধি    25-02-2023    180
মোশাররফের রাজত্ব কার দখলে যাচ্ছে

এক যুগের রাজত্ব। এ সময়ে ফরিদপুর সদরে গড়ে ওঠেনি কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে একে একে মন্ত্রিত্ব, দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদ হারানো ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফের রাজত্ব ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। গত আড়াই বছরে নিজ এলাকায় গেছেন হাতেগোনা কয়েকবার। নেই আগের দাপট। কাছের লোকজনও এখন ভিন্ন বলয়ে রাজনীতি করছেন। তার ‘এমপি’ পদও হারানো শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। এক সময় নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর থাকা গ্রামের বাড়ি ‘আফসানা মঞ্জিল’-এ এখন সুনসান নীরবতা। তার পরিবর্তে ফরিদপুর-৩ আসনের রাজত্ব এখন কার দখলে যাচ্ছে- এ প্রশ্ন স্থানীয় নেতাকর্মীদের।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ফরিদপুর-৩ আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ২০০৯ সালে তাকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী করা হয়। ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ফরিদপুরে রাজনীতিতে মোশাররফের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। এ সময় তার অনুগতরা বিভিন্ন সরকারি সংস্থার উন্নয়ন কাজের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি ও জমি দখল করে সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন।

২০২০ সালের ৭ জুন বিশেষ অভিযান চালিয়ে ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত এবং তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই দুজনই খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এর দুদিন পর ৯ জুন খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকায় চলে আসেন। এরপর ওই বছরের ১৪ জুলাই এক রাতের জন্য ফরিদপুর গিয়েছিলেন খন্দকার মোশাররফ। চাচির জানাজায় অংশ নিতে আরেকবার ফরিদপুর যান ২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। এরপর তাকে আর নিজের নির্বাচনী এলাকায় দেখা যায়নি। গত বছরের ৭ মার্চ রাতে মোশাররফের ভাই ফরিদপুর সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন তার সহকারী একান্ত সচিব ও জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক এ এইচ এম ফুয়াদ। দুজনকেই দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা জানান, খন্দকার মোশাররফ ক্ষমতায় থাকতে বাড়াবাড়ি করেছেন, মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। তিনি কোনো কিছুকে পরোয়া করেননি। এখন তারই ফল ভোগ করছেন। নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক পান্না বালা বলেন, ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য থাকাকালে এলাকায় যেমন উন্নয়ন করেছেন, তেমনি দুর্নীতিও করেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক বলেন, খন্দকার মোশাররফ হোসেন নানা কর্মকা-ের মাধ্যমে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগকে বিতর্কিত করেছেন। তিনি এক সময় যা ইচ্ছা তাই করেছেন। বিএনপি ঘরানার লোককে প্রাধান্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। তার সমর্থকরা অনেক অন্যায়-অবিচার করেছে।

এদিকে ফরিদপুরে খন্দকার মোশাররফের আফছানা মঞ্জিল এখন সুনসান। বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই বাড়ি। যেখানে রয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা, শান বাঁধানো ঘাট, নিজের জন্য দামি পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কবরস্থান। বছরে বিভিন্ন সময় দেশি-বিদেশি শিল্পী এনে করা হতো জমকালো অনুষ্ঠান। এখন সেখানে সুনসান নীরবতা। তার মেয়েরাও সেই বাড়িতে যান না। শহরের ঝিলটুনি এলাকায় হাসিনা মঞ্জিল নামে একটি বাড়ি আছে, মেয়েরা এলে সেখানে ওঠেন। বর্তমানে বাড়িটি দেখভাল করেন কেয়ারটেকার। আফসানা মঞ্জিল চত্বরের চিড়িয়াখানায় আগে অনেক হরিণ দেখা গেলেও এখন মাত্র ৫টি হরিণ আছে। বিদেশি কালো মুরগি আছে ২টি। আগে উট পাখি ছিল, এখন নেই। অল্প সংখ্যক কবুতর ও টিয়া দেখা গেছে।

এদিকে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনে দলের কোনো পদে তার ঠাঁই হয়নি। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় খন্দকার মোশাররকে। সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল একাদশ সংসদের সপ্তদশ অধিবেশনে যোগ দেন খন্দকার মোশাররফ। এরপর ৫৯ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন তিনি। স্পিকারের অনুমতি না নিয়ে সংসদ অধিবেশন চলাকালীন ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকলে এমপি পদ বাতিলের বিধান রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সংসদ অধিবেশন চলাকালে যদি কোনো এমপি দেশের বাইরে যেতে চান, তাহলে দরখাস্তের মাধ্যমে আমাকে অবহিত করে যেতে হবে। কিন্তু খন্দকার মোশাররফ হোসেন যখন দেশের বাইরে যান, তখন সংসদ অধিবেশন চলছিল না। এ ক্ষেত্রে অবহিত করা বাধ্যতামূলক নয়। তবে অনেক এমপি অধিবেশনের বাইরে বিদেশে গেলে আমাকে অবহিত করে যান। সংসদ সদস্য পদ বাতিল প্রসঙ্গে স্পিকার বলেন, টানা ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকলে তখন বিষয়টি বিধি অনুসারে বিবেচনা করা হবে।

জানা গেছে, খন্দকার মোশাররফ হোসেন এমপি বর্তমানে অবস্থান করছেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মেয়ের বাসায়। বিদেশে অবস্থানরত খন্দকার মোশাররফ হোসেন একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমার চিকিৎসা চলছে। সুস্থ হলে দেশে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।

খন্দকার মোশাররফের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, তিনি শিগগিরই দেশে ফিরছেন না। এদিকে এমপি পদ বাতিল হলে ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের কা-ারী কে হবেন- এ নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। এ ক্ষেত্রে আলোচনায় আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক। এ ছাড়া হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদের নামও আলোচনায় আছে।

জাতীয়-এর আরও খবর