২৮শ সরকারি ভবন ভূমিকম্প ঝুঁকিতে

  বিশেষ প্রতিনিধি    25-02-2023    194
২৮শ সরকারি ভবন ভূমিকম্প ঝুঁকিতে

তুরস্কের ভূমিকম্প ভয় দেখাচ্ছে রাজধানী ঢাকাকেও। যে কোনো সময় ঢাকাতেও বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। তাই ভূমিকম্পে করণীয় ঠিক করতে শিগগিরই একটি গাইডলাইন দেবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় ঢাকা শহরের সরকারি ভবনগুলোর ওপর একটি সমীক্ষা করেছে রাজউক। তাতে ৩ হাজার ২০০টি ভবন সমীক্ষা করে ২ হাজার ৮০০ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২৪০টি ভবন রয়েছে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। রাজউক বলছে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সংস্কার করে ভূমিকম্প সহনীয় করতে হবে আর অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো যত দ্রুত সম্ভব ভেঙে ফেলতে হবে।

রাজউক ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, তুরস্কের মতো ঢাকায়ও যদি সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, তাহলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। বিশেষ করে ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দেশে নেই। রাজউকের কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন তুরস্ক একটি উন্নত দেশ, সেখানেই উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে বেগ পেতে হচ্ছে। ঢাকায় এই মাত্রায় ভূমিকম্প হলে ভবনগুলো মাটির নিচে দেবে যেতে পারে। উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য রাস্তাও পাওয়া যাবে না। এসব বিষয় মাথায় রেখেই কর্মপরিকল্পনা করা দরকার।

ভূমিকম্পের ঝুঁকি এবং করণীয় নিয়ে অংশীজনের সঙ্গে আগামীকাল রবিবার রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) একটি কর্মশালার আয়োজন করবে। সেখানে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের করা জরিপ প্রকাশ করা হতে পারে। সেখানে বেরিয়ে আসতে পারে কোন কোন ভবন ভেঙে ফেলতে হবে, আর কোন ভবন রেট্রোফিটিং (দৃঢ়করণ) করতে হবে।

আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আব্দুল লতিফ হেলালী আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় ৩ হাজার ২০০ সরকারি ভবনের সমীক্ষা করা হয়েছে। প্রথম পর্বে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ভবনগুলোর সমীক্ষা করা হয়েছে। আমরা প্রস্তাব করেছি, ৩২০০ ভবনের মধ্যে ২৮০০ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সংস্কার করতে হবে। তার মধ্যে ২৪০টি ভবন অতি ঝুঁকিপূর্ণ, এগুলো যত দ্রুত সম্ভব ভেঙে ফেলতে হবে।’

ঢাকা শহরের আবাসিক ভবনগুলোর ওপর কোনো সমীক্ষা করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে রাজউকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা শিগগিরই ল্যাব স্থাপন করতে যাচ্ছি। আমাদের যন্ত্রপাতিও চলে আসবে। লোকবলেরও কোনো সমস্যা নেই। ঢাকা শহরের ৬ লাখ ভবন পর্যায়ক্রমে পরীক্ষার আওতায় আসবে। তা ছাড়া ব্যক্তিমালিকানার কেউ যদি আবেদন করে, আমরা সেটার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেব।’

এর আগে সর্বশেষ ২০১১ সাল থেকে জাইকার সহযোগিতায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তর পরিচালিত চার বছর মেয়াদি একটি জরিপে জানা যায়, গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে নির্মিত ঢাকার ২ হাজার ১৯৩টি সরকারি ভবনের ৫৯ শতাংশই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অধিকতর ঝুঁকিতে রয়েছে। ভবনগুলোর বয়স ২০ বছরের বেশি ও ইটের গাঁথুনিতে তৈরি। সেই ভবনের কোনোটি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আবার কোনো ভবন ওই অবস্থাতেই ব্যবহার করা হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের জরিপ অনুযায়ী, ঢাকা সিটি অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। ঢাকার অধিকাংশ পুরনো ভবন এবং নতুন ভবনের একটা বড় সংখ্যক ভবন ভূমিকম্প সহনীয় কোড অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়নি। তাদের একটি জরিপে আরও উঠে এসেছে, ঢাকা সিটির জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত নাজুক। ঢাকা শহরের কেন্দ্র হতে ৫০ কিলোমিটার দূরে যদি সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প উৎপন্ন হয় তাহলে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার ৬০৪টি ভবন মাঝারি মাত্রার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ২ লাখ ৩৮ হাজার ১৬৪টি ভবন অর্থাৎ ৭৩ শতাংশ ভবন মেরামত অযোগ্য হয়ে পড়বে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ড. মো. জিল্লুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ভূমিকম্পের উৎসগত দিক দিয়ে ঢাকা ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে ঝুঁকিটা বাড়িয়েছে এখানকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন। ঢাকার ভবনগুলো ভূমিকম্প ঝুঁকি বিবেচনায় গড়ে ওঠেনি। এখন ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি আকতার মাহমুদ আমাদের সময়কে বলেন, ঢাকা শহরে সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ ব্যক্তিমালিকানা ভবন অনেক বেশি। কাজেই যে পদ্ধতিতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন দ্রুত চিহ্নিত করা যায়, সেই পদ্ধতিতে কাজ করা দরকার। ঢাকা শহরে প্রত্যেক জোনে আলাদা আলাদা ইউনিটে ভাগ করে চিহ্নিতকরণের কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, ব্যক্তিগত ভবনের ফলাফল প্রকাশ করা একটু ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ওই ভবনের মালিক সংক্ষুব্ধ হতে পারেন, ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন। তাই সরাসরি প্রকাশ না করলেও তাদের বুঝিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো দ্রুত প্রকাশ করে দিলে রেট্রোফিটিং (দৃঢ়করণ) করা বা ভেঙে ফেলা যেতে পারে। রাজউকের উচিত অতিদ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে তালিকা প্রকাশ করা। এ বিষয়ে তিনি গণপূর্ত অধিদপ্তর ও হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভিজ্যুয়াল মেথড ব্যবহার করা যেতে পারে বলেও পরামর্শ দেন।’

ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত রাজউকের কর্মকর্তারাও। বিশেষ করে তুরস্কের ভূমিকম্পের পর সেখানকার আবাসন বিভাগের কর্মকর্তাদের যেভাবে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়েছে, বাংলাদেশেও এমনটি ঘটা স্বাভাবিক বলেই মনে করেন তারা।

ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েকটি প্লেট থাকার কারণে এসব এলাকা ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। তা ছাড়া সুনামগঞ্জ, জাফলং অংশে ডাউকি ফল্টের পূর্বপ্রান্তেও ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। এসব ফল্টে ভূমিকম্প হলে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বা বিপদের মাত্রা অনেক বেশি বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, উত্তরে তিব্বত সাব-প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট এবং দক্ষিণে বর্মা সাব-প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এ প্লেটগুলোর অবস্থান সিলেট-সুনামগঞ্জ হয়ে, কিশোরগঞ্জ-চট্টগ্রাম হয়ে একেবারে দক্ষিণ সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুই যুগ ধরে এ নিয়ে গবেষণা করেছে। সেখানে দেখা গেছে, ইন্ডিয়া প্লেট ও বর্মা প্লেটের সংযোগস্থলে দীর্ঘসময় ধরে কোনো ভূমিকম্পের শক্তি বের হয়নি। ফলে সেখানে ৪০০ থেকে হাজার বছর ধরে শক্তি জমা হয়ে রয়েছে। ইন্ডিয়া প্লেট পূর্ব দিকে বর্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে আর বর্মা প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে সেখানে যে পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে।

বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জে ৭.৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের ইতিহাস রয়েছে।

সারাদেশ-এর আরও খবর