হুমকিতে দেশের একমাত্র মেরিন ড্রাইভ

ভাঙন ও যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ

  বিশেষ প্রতিনিধি    03-09-2022    125
হুমকিতে দেশের একমাত্র মেরিন ড্রাইভ

পর্যটকদের কাছে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ এখন বেশ জনপ্রিয় স্থান। সড়কের একদিকে বঙ্গোপসাগর আর অন্যপাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়। এ দুটির সম্মিলন যেন দেশের একমাত্র মেরিন ড্রাইভকে করেছে অনন্য। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর নির্মিত সড়কটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই হাজারো পর্যটক এ পথ পাড়ি দেন। তবে কক্সবাজারের পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করা ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি এখন হুমকির মুখে। সমুদ্রসৈকত থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কারণে সৃষ্টি হয়েছে ভাঙন। তার ওপর যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত পরিবহনের চাপ, মেরিন ড্রাইভের পাশে গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘরবাড়ি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনই সংস্কারের ব্যবস্থা না নেয়া হলে যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে উঠবে সড়কটি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়েছে সাগরের পানির উচ্চতা। ফলে প্রতিনিয়ত বঙ্গোপসাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ আঘাত হানছে মেরিন ড্রাইভের ওপর। সাগরের বাড়তে থাকা উচ্চতা এবং পাড়ের অব্যাহত ভাঙনে তলিয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের পাশ ঘেঁষে তৈরি এ সড়কের কিছু অংশ পূর্ণিমার জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়। বিশেষ করে কলাতলী থেকে সাবরাং পর্যন্ত সড়ক চরম ঝুঁকির মুখে রয়েছে। সরজমিনে দেখা গিয়েছে, মেরিন ড্রাইভের কক্সবাজার অংশের কলাতলী, দরিয়ানগর, বড়ছড়া, হিমছড়ি, ইনানী, পাটুয়ারটেক, সি-পার্ল হোটেলের সামনেসহ টেকনাফের সাবরাং পর্যন্ত অংশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সড়ক রক্ষায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিকল্প ব্যবস্থায় এ ভাঙন প্রতিরোধ করা না হলে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কটি শিগগিরই হয়তো বিলীন হয়ে যাবে। অন্যদিকে মেরিন ড্রাইভকে ঘিরে যে পর্যটন গড়ে উঠেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাপে তার সম্ভাবনাও নষ্ট হতে চলেছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। শামলাপুর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারজুড়ে সড়কের দুই পাশে বসবাস করতে শুরু করেছে হাজারো রোহিঙ্গা নাগরিক। তারা নির্মাণ করেছে অসংখ্য ঝুপড়ি ঘর। ফলে সৈকতের পাশ দিয়ে যাওয়া এ সড়কটির যে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য সেটি আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। আবার শরণার্থীদের সহায়তা দিতে দেশে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর গাড়ির অতিরিক্ত চাপও মেরিন ড্রাইভের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসায়ীরা বলেন, দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত দেখতে কক্সবাজার আসেন লাখ লাখ দেশী-বিদেশী পর্যটক। কলাতলী হয়ে চলমান সাবরাং এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোনে চলে যান অনেকে। সেখানে পথের ভাঙন, অতিরিক্ত গাড়ির চাপ বা দুই পাশে শরণার্থীদের বসতি—কোনোটিই পর্যটকদের জন্য সুখকর নয়। কক্সবাজার পিপলস ফোরামের মুখপাত্র সাংবাদিক এইচএম নজরুল ইসলাম বলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে মেরিন ড্রাইভ সড়ক করা হয়েছিল তা ভেস্তে যাওয়ার পথে। কেবল শরণার্থী বসবাসই সমস্যা নয়, তাদের কারণে এ সড়কে বেড়েছে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার জন্য চলাচলরত বাহনের সংখ্যা। তার ওপর ভাঙনপ্রবণ কিছু এলাকা তো রয়েছেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে সড়কটি ভেঙে যাবে। তাই পর্যটকবাহী গাড়ি ছাড়া অন্যান্য কাজে ব্যবহূত গাড়ি চলাচলের জন্য বিকল্প সড়ক নির্মাণ করা উচিত। এছাড়া প্রভাবশালীদের সৈকত থেকে বালি উত্তোলনও বন্ধ করতে হবে। তা না হলে চমত্কার এ সড়কটি আর রক্ষা করা যাবে না। চলে যাবে সমুদ্রগর্ভে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজারের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, মেরিন ড্রাইভ সড়ক পর্যটনের আকর্ষণ বাড়াতে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। বর্তমানে এ সড়ক ব্যবহার করছেন দেশী-বিদেশী পর্যটকরাও। তবে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের পর তাদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার যানবাহন চলাচল এ সড়কে অনেক বেড়েছে। এতে সড়কের ভাঙন দীর্ঘ হচ্ছে। সড়কটি দিয়ে এসব যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয়া প্রয়োজন। লিংকরোড-টেকনাফ ও কলাতলী-মেরিন ড্রাইভ সড়ক বাদ দিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণ ও চলাচল করা যেতে পারে। এসবের পাশাপাশি অবৈধ বালি উত্তোলনও বন্ধ করা প্রয়োজন। সমুদ্রসৈকত ধরে এ সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় ১৯৮৯ সালে। ১৯৯৩ সালে তত্কালীন সরকার ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ প্রকল্প হাতে নেয়। সে সময় মাত্র দুই কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের পর তা সাগরের প্রবল স্রোতে বিলীন হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের (ইসিবি) তত্ত্বাবধানে নির্মাণকাজ শুরু হলেও ১৯৯৪ সালে প্রকল্পটি সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রকল্পটি পুনরায় সেনাবাহিনীর ইসিবির কাছে আসে। এর পরই প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্পন্ন হয় প্রকল্পটির নির্মাণকাজ। তিন ধাপে এ সড়কটির প্রথম পর্যায়ে কলাতলী থেকে ইনানি পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটারের নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০০৮ সালে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ইনানি থেকে শিলখালী পর্যন্ত আরো ২৪ কিলোমিটারের কাজ সম্পন্ন হয় ২০১৬ সালের জুনে। আর তৃতীয় পর্যায়ে শিলখালী থেকে টেকনাফের সাবরাং পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটারের কাজ ওই বছরের এপ্রিলে শেষ হয়। ২০১৭ সালের ৬ মে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত মোহনীয় সৌন্দর্যের মেরিন ড্রাইভ সড়ক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের করা সমীক্ষা বলছে, এ সড়ক নির্মাণের ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। বেকারত্ব কমেছে, পর্যটন ও নির্মাণ খাতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

সারাদেশ-এর আরও খবর