কক্সবাজারে দৈনিক উৎপাদিত হচ্ছে ১৫৭ মেট্রিক টনের বেশি শুঁটকি

  বিশেষ প্রতিনিধি    03-01-2023    308
কক্সবাজারে  দৈনিক উৎপাদিত হচ্ছে ১৫৭ মেট্রিক টনের বেশি শুঁটকি

কক্সবাজার উপকূলে এখন শুঁটকি মাছ উৎপাদনের ধুম পড়েছে। প্রতিদিন প্রায় ১১ কোটি টাকা মূল্যের ১৫৭ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে বেশির ভাগ শুঁটকি ট্রাকে বোঝাই করে সরবরাহ হচ্ছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে। সেখান থেকে সরবরাহ হচ্ছে তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে এ বছর জেলা থেকে ৪০০ কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদনের আশা করছেন উৎপাদনকারীরা।

কক্সবাজার পৌরসভার ১ ও ২ নং ওয়ার্ডের ১৮টি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে নাজিরারটেক শুঁটকি পল্লি। এখানে ছোট–বড় মিলিয়ে মহাল (শুঁটকি উৎপাদনের খামার) আছে প্রায় ৭০০টি। জেলার টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, মহেশখালী, সোনাদিয়া দ্বীপেও শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে জেলার ৯ শতাধিক মহালে দৈনিক উৎপাদিত হচ্ছে ১৫৭ মেট্রিক টনের বেশি শুঁটকি।

শুক্রবার সকালে নাজিরারটেক এলাকার আতিক এন্টারপ্রাইজ নামে একটি মহালে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে ৩০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে নারী শ্রমিক আছেন ১৯ জন। আরেফা বেগম (৩৬) নামে এক শ্রমিক বলেন, এখন শুঁটকির ভরা মৌসুম চলছে। গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে।

পাশের শাহ আমানত ট্রেডার্স নামে একটি মহালে শুঁটকি আছে ৬৫ মণের বেশি। সেখানকার শ্রমিক আমান উল্লাহ (৫৫) বলেন, শীতকালে শুঁটকির চাহিদা বেশি থাকে। তবে শুঁটকি উৎপাদন মূলত নির্ভর করে সাগরে কী পরিমাণ মাছ ধরা পড়ছে, তার ওপর। ট্রলারের জালে বেশি মাছ ধরা পড়লে শুঁটকির উৎপাদনও বেড়ে যায়।

পৌরসভার ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের সমিতিপাড়া, মোস্তাকপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, বাসিন্যাপাড়া, নুনিয়াছটা, সিসিডিবিমোড়, পানিকুপ পাড়াসহ অন্তত ১৮টি এলাকায় ছোট-বড় প্রায় ৭০০টি মহালে শুঁটকি উৎপাদন হচ্ছে। কায়সার এন্টারপ্রাইজ নামের একটি মহালের মালিক মো. কায়সার (৪৫) বলেন, সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মহালগুলোতে কাজ চলে। কক্সবাজার সৈকত ভ্রমণে আসা বিপুলসংখ্যক পর্যটক বাড়ি ফেরার সময় কয়েক কেজি করে শুঁটকি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণে শুঁটকির চাহিদাও বেশি।

স্থানীয় মহাল ও বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, মহালে উৎপাদিত প্রতি কেজি ছুরি শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১০০০, লইট্যার কেজি ৫০০ থেকে ৬০০, ফাইস্যা ৩০০ থেকে ৩৫০, পোপা ৪০০ থেকে ৪৫০, মাইট্যা ১২০০ থেকে ১৫০০, রূপচাঁদা ৩২০০ থেকে ৩৭০০, লাক্ষ্যা ২০০০ থেকে ২৩০০ ও কোরাল ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকায়। স্থানীয় খুচরা বাজারে এসব শুঁটকি কেজিতে আরও ২০ থেকে ২০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুঁটকির দাম গত বছরের তুলনায় এবার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে।

নাজিরটেক শুঁটকি ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, মহালে উৎপাদিত শুঁটকি ব্যবসায়ীরা কিনে এনে প্রথমে গুদামে মজুত করে রাখেন। তারপর প্রতি সপ্তাহে শুক্র ও মঙ্গলবার শুঁটকি ট্রাকবোঝাই করে চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হয়। গত সপ্তাহে ৪০ ট্রাক (প্রতি ট্রাকে ১২-১৩ টন) শুঁটকি পাঠানো হয়েছে। তার আগের সপ্তাহে পাঠানো হয় ৪২ ট্রাক শুঁটকি। এবার চড়া মূল্যে কাঁচা মাছ কিনতে হচ্ছে বলে গত বছরের তুলনায় শুঁটকির দাম অনেক বেড়েছে বলে জানালেন আতিক উল্লাহ।

পৌরসভার সংরক্ষিত ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহীন আক্তার পাখি বলেন, ১৮টি গ্রামে গড়ে ওঠা ৭০০টি শুঁটকি মহালে ২৫ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে প্রায় ১৭ হাজার নারী আছেন। বছরের শেষ সময়ের কয়েক দিনে সৈকতে লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। এ জন্য শুঁটকির বেচাকেনাও বেড়েছে। তবে আগে শুঁটকি ছিল গরীবের খাদ্য। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন মধ্যবিত্ত পরিবারও শুঁটকির নাগাল পাচ্ছেন না।

আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত শুঁটকি উৎপাদন চলবে জানিয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলায় শুঁটকি উৎপাদন হয়ছিল ৩১ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২০২৩) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪২ হাজার মেট্রিক টন। গত নভেম্বর মাসে নাজিরারটেক মহালসহ জেলার বিভিন্ন উপকূলে শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছে পাঁচ হাজার মেট্রিক টনের বেশি। প্রতিদিন যে পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে, তাতে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম হতে পারে বলে আশা করছেন তিনি।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক আবিদ আহসান বলেন, ভ্রমণে আসা পর্যটকসহ দেশের মানুষকে বিষমুক্ত শুঁটকি সরবরাহ করতে কাজ চলছে। গত বছর কক্সবাজারে প্রায় ৩৩০ কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছিল। পরিবেশ-পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এবার শুঁটকির উৎপাদন ৪০০ কোটি টাকার কাছাকাছি যেতে পারে।

সারাদেশ-এর আরও খবর