বড়দিন: পৃথিবীতে মুক্তিদাতার আগমন

  বিশেষ প্রতিনিধি    25-12-2022    156
বড়দিন: পৃথিবীতে মুক্তিদাতার আগমন

আজ ২৫ ডিসেম্বর। বড়দিন বা ক্রিসমাস ডে। বিশ্বজুড়ে দিনটি পালিত হচ্ছে যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন হিসেবে। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের কাছে যিশু মুক্তিদাতা। পুত্র রূপে স্বয়ং পিতা ঈশ্বর। সকল মানুষের মুক্তির জন্য পৃথিবীতে যিশুর আগমন ঘটেছিল। যিশুর জন্ম মানুষের জন্য এক মহা আনন্দের সংবাদ। বড়দিন মুক্তিদাতা যিশু খ্রিষ্টের জন্মোৎসব।

প্রায় দুই হাজার বছরেরও কিছু আগে যিশু খ্রিষ্ট পৃথিবীতে এসেছিলেন। যিশুর পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে পাপ থেকে মুক্ত করা। বাইবেলে মথি এবং লূকের সুসমাচারে যিশুর জন্ম সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যিশুর জন্ম হয়েছিল অলৌকিকভাবে, এক কুমারী নারীর গর্ভে। সেই কুমারীর নাম ছিল মেরি (মরিয়ম)। যোসেফ নামে এক কাঠমিস্ত্রির বাগদত্তা ছিলেন মেরি। যোসেফ ও মেরি দুজনেই ধার্মিক ও ঈশ্বরের প্রতি গভীর বিশ্বাসী ছিলেন।

সে সময় একদিন মেরির কাছে একজন স্বর্গদূত এলেন। তিনি মেরিকে জানালেন যে সে (মেরি) এক পুত্রসন্তান প্রসব করবে। স্বর্গদূতের এমন কথা শুনে মেরি ভীষণ বিচলিত হলেন। কারণ তখনো যে তার বিয়ে হয়নি এবং কোনো পুরুষের সঙ্গে মেলামেশাও হয়নি। স্বর্গদূত তাকে জানান সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের পরিকল্পনা অনুযায়ী পবিত্র আত্মার প্রভাবে তিনি গর্ভবতী হবেন। আর তার গর্ভে যে সন্তান জন্ম নেবে, সে হবে পবিত্র অর্থাৎ সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত। স্বর্গদূত শিশুটির নাম যিশু রাখার কথা বলেন। যে নামের অর্থ ত্রাণকর্তা বা মুক্তিদাতা।

এদিকে, মেরি সন্তান সম্ভবা এই কথা জানতে পেরে যোসেফ তাকে গোপনে ত্যাগ করবেন বলে স্থির করেছিলেন। কিন্তু সেই স্বর্গদূত স্বপ্নে তাকে দেখা দিয়ে বলেন যে, ঈশ্বরের শক্তি এবং পবিত্র আত্মার প্রভাবে মরিয়মের গর্ভে সন্তান এসেছে। এই সন্তান মানুষকে পাপ থেকে মুক্ত করবেন। তাই যোসেফ যেন মেরিকে গ্রহণ করতে দ্বিধা না করেন। দূতের দর্শন পেয়ে যোসেফ সমস্ত বিষয় বুঝতে পারেন। তিনি মেরিকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। তবে যতদিন পর্যন্ত যিশুর জন্ম না হয়, ততদিন পর্যন্ত তারা শারীরিক সম্পর্ক থেকে বিরত থাকেন।

যিশুর জন্মের সময় ঘনিয়ে এলে রোমান সম্রাটের নির্দেশক্রমে নাম লেখানোর (জনশুমারি) আদেশ জারি হয়। যোসেফ গালীলের নাসরৎ নগরের হলেও দায়ূদের বংশধর বলে সে সময় তারা যিহুদিয়ার বেৎলেহেমে যান। তবে সেখানে থাকার জন্য তারা ভালো কোনো স্থান পেলেন না। একটি গোয়ালঘরে তাদের জায়গা মেলে। সেখানেই জন্ম হয় যিশুর। মেরি সদ্য ভূমিষ্ঠ যিশুকে কাপড়ে জড়িয়ে একটি যাবপাত্রে (পশুর খাবার খাওয়ার বড় পাত্র) শুইয়ে রাখেন।

বাইবেলে বর্ণিত আছে, যিশুর জন্ম হলে এই সংবাদ নিয়ে এক স্বর্গদূত সেই অঞ্চলের মেষপালকদের কাছে যান। দূতকে দেখে মেষপালকরা ভয় পান। কিন্তু স্বর্গদূত তাদের বলেন, ভয় করো না, কারণ দেখো আমি তোমাদেরকে এক মহানন্দের সুসমাচার জানাতে এসেছি। সেই আনন্দ সব মানুষের হবে। কারণ আজ দায়ূদের নগরে তোমাদের জন্য ত্রাণকর্তা জন্মেছেন। তিনি খ্রিষ্ট প্রভু।

মেষপালকরা যাতে যিশুকে খুঁজে পেতে পারেন সেজন্য স্বর্গদূত তাদের বিশেষ চিহ্ন বা নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, তোমরা দেখতে পাবে একটি শিশু কাপড়ে জড়ানো এবং যাবপাত্রে শোয়ানো আছে। দূতের কথামতো মেষপালকরা গিয়ে শিশু যিশুকে খুঁজে বের করেন এবং তাকে দেখে আসেন। তারা যিশুকে একটি মেষ বা ভেড়া উপহারও দেন।

সেই সময়ে আকাশে নতুন এক তারা দেখতে পেয়ে ভিনদেশের কয়েকজন জ্ঞানী ব্যক্তি বুঝতে পারেন মহান কোনো ব্যক্তির জন্ম হয়েছে। জ্ঞানী ব্যক্তিরাও তখন নানা বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে যিশুকে খুঁজে বের করেন। তারা যিশুকে স্বর্ণ, কুন্দ্র ও গন্ধরস উপহার দেন।

বড়দিনে গির্জা বা চার্চে যিশুর জন্মের সময়কার আশ্চর্য এই ঘটনাগুলোর ওপর আলোচনা করা হয়। স্মরণ করা হয় তার জন্মগ্রহণের উদ্দেশ্যকে। যিশুর জন্ম, জীবন ও কাজ ছিল আশ্চর্য সব ঘটনায় পরিপূর্ণ।

বাইবেলের মতে, তিনি এই পৃথিবীতে এসেছিলেন মানুষকে মুক্তি পথ দেখাতে। তাদেরকে পাপ থেকে পরিত্রাণ করতে। তার জন্মের অনেক আগেই ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছিল যে যিশু মানুষের পাপ নিজের কাঁধে নিয়ে ক্রুশে মৃত্যুবরণ করবেন। মৃত্যুকে জয় করে তিনি আবার পুনরুত্থিত হবেন। সেই ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী সবকিছু ঘটে।

যিশুর জন্মদিন হিসেবে ক্রিসমাস বা বড়দিন পালনে বর্তমানে আমার যেসব উৎসবের আয়োজন দেখি, সেগুলো একদিনে হয়নি। যিশুর জন্মের বহু পরে বড়দিন পালনের শুরু হয়। এমনকি শুরুর দিকে খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে বড়দিন অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

২০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মিসরে প্রথম বড়দিন পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়। সে সময় ভিন্ন ভিন্ন তারিখে যিশুর জন্মদিন উৎযাপনের কথা জানা যায়। ৩৫৪ খ্রিষ্টাব্দের রোমান পঞ্জিতে ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্ম হয় উল্লেখ করে দিনটিকে যিশুর জন্মদিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

৪৪০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান ক্যাথলিকদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ এই তারিখটিকে স্বীকৃতি দিলে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন উদযাপন ব্যাপক আকার পায়। বর্তমানে এই দিনটি যিশুর জন্মদিন হিসেবে সারা বিশ্বে মহা আড়ম্বরে পালিত হচ্ছে।

যিশুর জন্মের সময়ের যে ঘটনাগুলোর বর্ণনা বাইবেলে পাওয়া যায়, সেগুলো সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো ক্রিসমাস বা বড়দিন উৎযাপনের মূল উপকরণ। এর সঙ্গে সময় ও স্থানভেদে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ইত্যাদির সংমিশ্রণ ঘটেছে। যার ফলে আজ আমরা বড়দিন বলতে নানা কিছু দিয়ে সাজানো ক্রিসমাস ট্রি, ক্রিসমাস ফাদার এবং বিশেষ টুপি, তারা, মেষশাবক বা ভেড়া, রাখাল, জ্ঞানী ব্যক্তি এরকম বিভিন্ন উপকরণ দেখতে পাই।

ক্রিসমাস পরিবারের সদস্যদের মিলনের এক মাধ্যমও। বড়দিন উপলক্ষে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ তাদের প্রিয়জনের কাছে ছুটে যান। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন সবাই সবার সঙ্গে মিলিত হন। সবাই মিলে একত্রে আনন্দে কয়েকটি দিন অতিবাহিত করেন। সাধ্য অনুযায়ী একে অন্যকে উপহার দেন।

খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন মন্ডলী বা চার্চ ভেদে বড়দিন উৎযাপনে কিছুটা ভিন্নতা থাকে। তবে বড়দিন উৎযাপনের মূল বিষয় হলো যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন পালন। এই পৃথিবীতে তার আগমনের উদ্দেশ্য স্মরণ করা। কারণ যিশুর জন্ম মানুষের জন্য এক সুসংবাদ।

বড়দিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যিশুর জন্ম মানুষের মুক্তির দ্বার উন্মোচন করে। তার জন্ম সবার জন্য আনন্দের। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর সব মানুষের জন্য বড়দিন বয়ে আনুক স্বর্গীয় শান্তি এবং অশেষ সমৃদ্ধি। সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা। শুভ বড়দিন।

জাতীয়-এর আরও খবর