শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৩য় টার্মিনালে আধুনিকতার ছোঁয়া

  বিশেষ প্রতিনিধি    16-10-2022    152
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৩য় টার্মিনালে আধুনিকতার ছোঁয়া

বিশ্বায়নের এযুগে সময়ের সাথে তালমেলাতে উন্নয়নের বিকল্প নেই। এ উন্নয়ন হতে হবে টেকসই এবং সময়োপযোগী। বর্তমান সরকার উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে গত ১৩ বছরে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ তার মধ্যে অন্যতম। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের গুরুত্ব, প্রতিবছর আকাশপথে যাত্রীসংখ্যা বৃদ্ধি, কার্গো পরিবহনে চাহিদা বৃদ্ধি, বিদ্যমান টার্মিনালে ধারণক্ষমতার অধিক যাত্রী চলাচল, দেশের বর্তমান পরিবহণ চাহিদা এবং হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অপর্যাপ্ত অবকাঠামোকে বিবেচনা করে আকাশপথে চলাচলকারী যাত্রীদের আধুনিক সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে টার্মিনালটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ৩০ লাখ বর্গফুট জায়গায় তিনতলা বিশিষ্ট এ টার্মিনাল ভবনটির আয়তন হবে ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার এবং লম্বা ৭০০ মিটার ও চওড়া ২০০ মিটার। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের আদলে গড়ে তোলা হচ্ছে এ বিমানবন্দরকে। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়। এর আগে ২০১৫ সালে বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ ও সম্প্রসারণের প্রাথমিক সম্ভাব্যতা প্রতিবেদন ও খসড়া মাস্টারপ্ল্যান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উপস্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দেন। ২০১৭ সালের ১১ জুন এ প্রকল্পের জন্য চারটি প্রতিষ্ঠানকে যৌথভাবে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পের মেয়াদকাল ছিল ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু নানা কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করা যায়নি। ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমানে কাজ ধারণার চেয়েও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রতিদিন কয়েকটি শিফটে ভাগ করে দেশি বিদেশি চার হাজার শ্রমিক কাজ করছে প্রকল্পটিতে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ প্রত্যাশার চেয়ে ১ দশমিক ৯ শতাংশ এগিয়েছে। ৮ এপ্রিলের ২০২২ এর মধ্যে টার্মিনালের নির্মাণ কাজের ৩২ দশমিক ৭ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষে ২০২৩ সালের অক্টোবরের মধ্যে তৃতীয় টার্মিনালটি উদ্বোধন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ করছে স্যামসাং গ্রুপের কন্সট্রাকশন ইউনিট স্যামসাং কনস্ট্রাকশন এবং ট্রেডিং (সিঅ্যান্ডটি) করপোরেশন। অত্যাধুনিক নির্মাণ কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি কর্পোরেশন আকর্ষণীয় নির্মাণ সাফল্যের বিস্তৃত পোর্টফোলিও তৈরি করেছে। ইতিমধ্যে, প্রতিষ্ঠানটি প্রকৌশল ও নির্মাণসংস্থা হিসেবে বিভিন্ন খাতে নিজেদের শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত করেছে। স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশন উঁচু ভবন থেকে বিমানবন্দর, চিকিৎসা সুবিধা এবং অত্যাধুনিক উৎপাদন সুবিধাসম্পন্ন স্থাপনা নির্মাণ করতে সক্ষম। বুর্জ খলিফা, পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, তাইপে ১০১, সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের ৪ নম্বর টার্মিনাল, দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচেওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আবুধাবির ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকসহ আরও অনেক স্থাপনার সফল নির্মাতা এই স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশন। বিমান বন্দরের প্রধান টার্মিনালের দক্ষিণ পাশে তৃতীয় টার্মিনালটি নির্মাণ করা হচ্ছে, যার আনুমানিক নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে বাংলাদেশি টাকায় ২১ হাজার ৪০০ কোটি। টার্মিনালটি নির্মাণে ৫ হাজার কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার এবং নির্মাণ ব্যয়ের বাকি অংশ আসবে জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা’র (জাইকা) তহবিল থেকে। টার্মিনালটি নির্মাণে স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশন ৫ হাজার কোটি (১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার) টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। বর্তমান টার্মিনাল দুটোতে বছরে ৮ মিলিয়ন যাত্রীসেবা দেয়ার সক্ষমতা থাকলেও টার্মিনাল ব্যবহার করছে ১৩.৯২ মিলিয়ন যাত্রী। অত্যাধুনিক নতুন টার্মিনালটি চালু হলে বছরে দুই কোটির বেশি যাত্রী এই বিমানবন্দর দিয়ে দেশ-বিদেশে চলাচল করতে পারবেন। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে যাওয়ার জন্য রাজধানীর কাওলা রেলস্টেশনকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। দেশ থেকে যাঁরা বিদেশ যাবেন বা বিদেশ থেকে যাঁরা দেশে আসবেন তাঁদের যাত্রা সহজ করতে বিমানবন্দরকে সাজানো হচ্ছে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে যেতে আরও একটি পথ ব্যবহার করা যাবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে সরাসরি চলে যাওয়া যাবে নির্মিতব্য নতুন টার্মিনালে। বিমানবন্দর এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টার্মিনালে নামার জন্য রাখা হচ্ছে আলাদা ব্যবস্থা। ঠিক একই পথ ব্যবহার করে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যাওয়া যাবে। সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রোহানি বাহরিনের নকশায় এভাবেই তৈরি করা হচ্ছে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালটি। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্ল্যাইটের ঘণত্ব দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে প্রতিদিন ২৬০ টি বিমান ওঠানামা করে এ বিমানবন্দর থেকে। বেবিচকের তথ্য অনুযায়ী, রানওয়েতে উড়োজাহাজের চাপ কমাতে তৃতীয় টার্মিনালে তৈরি হচ্ছে দুটি হাইস্পিড টেক্সিওয়ে, উড়োজাহাজ রাখার জন্য ৩৭টি এপ্রোন পার্কিং। বর্তমানে এপ্রোন পার্কিং আছে ২৯টি। তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ শেষে এপ্রোন পার্কিং এর সংখ্যা হবে ৬৬টি। ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজ, প্রথম ধাপে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ চালু হবে। বহির্গমনের জন্য ১৫টি সেলফ সার্ভিস চেক ইন কাউন্টারসহ মোট ১১৫টি চেক ইন কাউন্টার থাকবে তৃতীয় টার্মিনালে । নির্মিতব্য তৃতীয় টার্মিনালে ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল কাউন্টারসহ ৬৬টি ডিপারচার ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকবে। আগমনীর ক্ষেত্রে পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় চেক ইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি পাসপোর্ট ও ১৯টি চেক ইন অ্যারাইভাল কাউন্টার থাকবে। এর বাইরে টার্মিনালে ১৬টি আগমনী ব্যাগেজ বেল্ট স্থাপন করা হচ্ছে। বছরে দুই কোটি যাত্রীসেবা দিতে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তৃতীয় টার্মিনালের সঙ্গে মাল্টিলেভেল কার পার্কিং ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ১৩৫০টি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। তৃতীয় টার্মিনাল ভবনের সঙ্গে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ পথ ও উড়াল সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে মেট্রোরেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ ব্যবস্থা থাকবে। এতে থাকবে আন্তর্জাতিক মানের অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা। তৃতীয় টার্মিনাল প্রকল্পের প্রথম ধাপের সঙ্গে বর্তমান টার্মিনাল ভবনগুলোর আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা থাকবে না। তবে প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে কানেকটিং করিডোরের মাধ্যমে পুরনো টার্মিনাল ভবনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হবে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উত্তর পাশে রয়েছে আমদানি ও রফতানি কার্গো ভিলেজ। যার মাধ্যমে ২০১৯ সালে ০.৪১২ মিলিয়ন টন পণ্য পরিবহণ করা হয়েছে। পণ্য পরিবহণের বর্ধিত চাপ সামাল দিতে বর্তমান কার্গো ভিলেজের উত্তর পাশে যথাক্রমে ৩৬ হাজার বর্গমিটার ও ২৭ হাজার বর্গমিটার আয়োতনের সর্বাধুনিক সুবিধা সম্পন্ন দুটি পৃথক আমদানি ও রফতানি কার্গো ভিলেজ নির্মিত হচ্ছে। টার্মিনালের কাজ শেষ হলে বিমানবন্দরটি বর্তমান দুই লাখ টন থেকে পাঁচ লাখ টন কার্গো হ্যান্ডলিং করতে পারবে। বর্তমানে দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বাড়ার পাশাপাশি সক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত হিসেবে দেখা যায়, দেশের ১ কোটি ৩৬ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ জন কর্মী বিদেশে কাজ করছে এবং তাদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ প্রায় ১৮ লাখ ৯৩ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। এটাকা দেশের অর্থনীতির প্রাণ। এই প্রবাসীরাই দেশে যাতায়াতের ক্ষেত্রে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে বিবিন্ন সময় তারা নানা অসুবিধায় পড়েন। তাদের এ যাতায়াতকে স্বাচ্ছন্দপূর্ণ করতে নির্মিতব্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল সহায়ক হবে বলে সকলের বিশ্বাস। লেখক : মুহম্মদ জসীম উদ্দিন, সহকারী তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর ।

জাতীয়-এর আরও খবর